মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় : তোমার কবিতা
তোমার সমসাময়িকদের থেকে আলাদা কোথায় ?
স্বপন রায় : ধরো কুয়াশা লিখে শান্তি
হলো না,লিখলাম মিথিলকুয়াশা....কেন? সেই আবছা জলীয় আবহাওয়াটার জন্যই কি মিথিল?মানে কি মিথিলের?শিথিল দোষ কি
করলো?নাকি মিথ থেকে মিথিল?কোথাও কি মিথিলা রয়েছে ভেতরে?
আমি কোথায় আমার সমসাময়িকদের চেয়ে আলাদা?মৃগাঙ্ক আমি তো
অসমসাময়িকদের চেয়েও আলাদা! কিন্তু কেন?”নদী কোথা হইতে আসিয়াছ?”-মহাদেবের জটা
হইতে!স্বপন কোথা হইতে?এতেই কিছুটা আলাদা হওয়ার কারণ রয়েছে মনে হয়!আমি রাউরকেলা
হইতে...রাউরকেলা!তো আমার লেখায় কিছু আবছা,কিছু নীরব,কিছু রাস্তা অনারম্ভের,কয়েকটা
চিমনি,সাইকেলিক টুং টাং এ সব আনমনে থেকে যায়,এম্নি এম্নি.....আলাদা এ ভাবেই একজন
হতে থাকে,মানুষ হিসেবে!তবে কবিতা লেখার প্রক্রিয়ায় এই আলাদা রঙের অন্যদিকে থাকে
প্রচলের টান,প্রথার মায়া,বাঙালির ক্ষমতার প্রতি সাধারণ আনুগত্য,খ্যাতির
হাততালি.....এ ভাবে কবিরা জড়িয়ে যায় পুরনো রাস্তার নিরাপত্তায় আর এটা অস্বাভাবিকও
নয়...এমন কবিরা আলাদা হতে চায়না..
‘চে’ লিখতে লিখতে আমি বাংলা ধারাবাহিক কবিতা থেকে আলাদা
হতে থাকি, চে গেভারা এবং তাঁর ডায়েরি আমায় তখনকার শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রভাবিত
ছন্দশাসিত বাংলা কবিতার একঘেয়েমি থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছিল,এ এক চরম
অসহায়তা ! আমি আমার চর্চিত
ছন্দোময় টেকনিকে আর ফিরতে চাইছি না,অন্যদিকে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ র ওই সময়ে আমি
নতুনধারার কাব্যকৃতি থেকেও অনেক দূরে দাঁড়িয়ে রয়ছি!এর ফল হলো এ রকম যে আমি নিজের
লেখা খুঁজে না পাওয়া অব্দি আর লিখবো না এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম!প্রায় ২
বছর লেখা প্রকাশের দিকে না ঝুঁকে গোপন এক খেলায় মজে গেলাম!আমি,তুমি,চিত্রকল্প,ক্রিয়ার
বাহুল্য যতটা সম্ভব এড়িয়ে কি ভাবে স্বছন্দ বাংলা কবিতা লেখা যায়?আমার দেখা,আমার
ঘোরাঘুরি,আমার যাপনে লেগে থাকা তুচ্ছ অনুভবগুলি বিষয়ের কংক্রিটকে হাল্কা করে
দিল,আমি ধ্বনির ছবিতে মুছে দিতে চাইলাম চিত্রকল্পের একঘেয়েমি,ধ্বনি ছবি হয়ে উঠতে
আরম্ভ করলো,দুঃখ কষ্টের আগুন মোলায়েম হয়ে উঠতে শুরু করলো,আমি লেখার আনন্দে ফিরে এলাম আবার!
১৯৯২ থেকে শুরু এই অভিযাত্রায় আমি কবিতা লিখেছি কিনা
জানিনা,তবে আনন্দে থেকেছি!টুলরোদ,চিঠিরূপ
চিঠিকাল,ছুটি-ডানা,সেতু-চোখ,হরিণ-মাস,গাভীন-কূল,ভোরাজ,শিশি-চমকা,টায়ার-নীচু
এল্পাইন-স্কারট,কাওয়াসাকি হৈ-চুর,আচৈঁতি মেয়েরা,অংশালুবতা,কাহা-ভোরঙ,অপার্ক –কুসুম,শোয়াচুর,ভিলা-চিখ
উটল-ফায়ার,রোদচলা,নৌ-মুচকি,পায়ে-পায়রায়-রায়ে,স্তন-মূর্ছা কোণ,ধুপকে যাচ্ছে সাঁইয়া রে,মৌবাদী
স্কারফে,ফেরীমন সোয়েটারের বল্পশমে,পেয়ালাজনিত ঈশ,নার্সতোয়া.....এ সব আমার সাধ্যে
চলে আসে,লিখতে থাকি....কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ একদিন ফোন করে বললো,স্বপন দা,লেনিন
নগরী,কুয়াশা কেবিন,ডুরে কমনরুম,মেঘান্তারা জুড়ে তুমি অন্ততঃ হাজারের কাছাকাছি নতুন
শব্দ লিখে ফেলেছো,তুমি জানো এটা?....হাজার কিনা জানিনা তবে এটা জানি এই শব্দগুলো
কল্পশব্দ,জোর করে নতুন করার জন্য বা চমক দেয়ার জন্য একটা শব্দও লিখিনি,এ সবই ছিলো
আমার অনুভূতির বাহক যা প্রচলিত শব্দ ভান্ডার দিয়ে আমি প্রকাশ করতে পারছিলাম
না!বিষয় থেকে দূরে যাওয়ার জন্যই তো কবিতা লেখা,তো বাংলা ভাষার ভেতরে থাকা লিরিক কে
আরো সুক্ষ্ম করে যদি একধিক ধ্বনিচিত্র নিয়ে আসা যায়,যদি....”নদীজান তুললো
পানীয়/আল-ও-পাইন ছেঁড়া সারাজীবনের/কতটা জল/আন বোতামের সারঙ্গা,দেখা যাবে ঝিকি
নাচছে ধাকে/পুলপারে অবন্তীপারের সাইকেল..”এ ভাবেই লিখেছিলাম!কবিতা হলো কিনা
ভাবিনি,লিখে আনন্দ পাচ্ছিলাম,ভাষাকে সচল করার তাগিদে তার ভেতরে বেশি বেশি
ধ্বনি,সুর,বিমূর্ততা,দেখার তরঙ্গে মেশা প্রকৃতি,রোমান্স,অভিযাত্রা আর শোকনিড়োন
আনন্দ ভরে দিচ্ছিলাম,হয়তো এ ভাবেই আলাদা হয়ে যাচ্ছিলাম...আমি সৌভাগ্যবান যে,যেসব
বন্ধুদের সঙ্গে এই নতুনায়নের খেলায় মেতে উঠেছিলাম তারা কেউ কারো মত লিখতো না,সবাই
স্বতন্ত্র ছিলো,নতুন কে আন্দোলনের সাধারণ স্তরে কেউ নামিয়ে আনেনি,কবিতাকে নষ্ট করা
নয়,কবিতাকে নির্মাণ করার দিকে নজর ছিল সবারই...আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না....
আমি কবিতাকে খুঁজে বেড়াই,খ্যাপা যেরকম!মাধবীমূলক
দ্বন্দ্ববাদ এই খোঁজের থেকেই এসেছিলো!এই যে বস্তুকে সার মেনে বস্তুকে তত্ত্বের জাল
থেকে বের করে আনা এ আমার খুবই প্রিয় খেলা!আমি কোনদিনও কোন তত্ত্ব বা দর্শন মাথায়
রেখে কবিতা লিখিনি!”চোখ বুঁজে আর কি দেখতে হয়,স্বপ্ন ছাড়া..”এ সেই ঘর ছেড়ে বেরোন
চেতনার অন্ধকার অচেনা জগত,যেখানে চোখ না বুঁজলে আলোর অভিসার হবে না!এখানেই তো,’কথা
বসে আছে চোখে/চোখ টানা হয়ে বারান্দায়” বা “নাকছাবির ঈষৎ মুচকি যেদিকে নেমে গেলো”আর
“আমাদেরই নদীর চেয়ে বড় অপেক্ষারা/আমাদেরই পিওন শুধু হাঁটে যখন একটু আগে বৃষ্টি”..আমি
এই কবিতাকে কখনো কখনো ধরে ফেলি,বেশিটাই পারিনা...তবে যা লিখেছি নিজের লেখাই
লিখেছি,কারো মত লিখিনি,লিখতে চাইও না....আমি তো এ রকমই মনে করি,যা লিখেছি হয় সে
সবই অনেকদিন কবিদের পাথেয় হয়ে থাকবে,নয় তো মুছে যাবে...মাঝামাঝি থাকবে এমন কবিতা
আমি লিখতে চাইনি কখনো....আলাদা হওয়াটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়,সং সেজেও আলাদা
হওয়া যায়....আমি তো আলাদা হওয়ার জন্য কবিতায় থাকিনি,নিজের জন্য থেকেছি,বেঁচে থাকার
জন্য থেকেছি...আর যখন এই থাকাটা মানুষের ভালোবাসায় মিশে গেছে,মনে হয়েছে,বারে বারেই
মনে হয়েছেঃ”দ্রবরিক্সার কাছে ভোর হল/শ্রাবণ শুরু হল…”