অনুপম মুখোপাধ্যায়: মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

মলয় রায়চৌধুরী। বাংলা কবিতার নুন-ছাল উঠে যাওয়া চেহারাটা যেন চোখের সামনে জেগে ওঠে যখন এই নামটি উচ্চারিত হয়। ১৯৬১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত তিনি বাংলা কবিতা লিখেছেন। সেই চর্চা বাঙালি পাঠককে স্বস্তিতে রাখেনি। যাটের দশকের বিখ্যাত, অনেকের মতে কুখ্যাত, হাংরি আন্দোলনের মলয়ই ছিলেন প্রাণপুরুষ। এই আন্দোলন তাঁকে কারাদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম বাঙালি কবি, তাঁর কোমরে পড়েছিল পুলিশের দড়ি, হাঁটানো হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। অভিযোগ ছিল কবিতায় অশ্লীলতা। শুরু হয়েছিল বিখ্যাত হাংরি মামলা, যা আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,তরুণ সান্যাল, সত্রাজিৎ দত্ত, জ্যোতির্ময় দত্ত নিম্ন আদালতে সাক্ষী ছিলেন মলয়ের হয়ে। সেই কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার‘। বাংলা কবিতার অন্যতম স্বল্পপঠিত বিখ্যাত কবিতা। আজ সেই মলয় রায়চৌধুরী মুম্বাই প্রবাসী। কলকাতাকে পাকাপাকিভাবে ছেড়ে সেখানে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে ধরা গেল। ধরা দিলেন আন্তর্জালে। রাজি হলেন এই সাক্ষাৎকার দিতে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছে ই-মেলের মাধ্যমে। উঠে এসেছে অনেক বিতর্কিত, অস্বস্তিকর, বিস্ফোরক প্রসঙ্গ। হয়তো প্রথমবার মলয় রায়চৌধুরী নিজের বলয়ের বাইরে প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হলেন।
মলয় রায়চৌধুরীর (জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯) অনেক পরিচয় আছে। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। কিন্তু এখনও তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিনি ষাটের দশকের সেই বিখ্যাত হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ। তখন, এবং এখন, সাহিত্যের কোনো অনুশাসন তিনি কখনও মানতে চাননি। সে ষাটের হাংরি আন্দোলন হোক বা শতকশেষের অধুনান্তিক চিন্তা।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান মলয়। বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী-ফোটোগ্রাফার। মা অমিতা ছিলেন রোনাল্ড রসের সহায়ক কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা। বড়দা সমীর রায়চৌধুরীও একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। শৈশব কেটেছে পাটনায়। সেখানে সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রথমিক শিক্ষা হয়। পরে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেশজ্ঞ হিসাবে প্রশিক্ষণের পর প্রথমে রিজার্ভব্যাঙ্ক, পরে এ আর ডি সি এবং নাবার্ডে উচ্চপদে ভারতের বিভিন্ন শহরে কর্মরত ছিলেন। সারা জীবন ভারতের চাষি, তাঁতি, জেলে, হস্তশিল্পীদের মধ্যে কাটিয়ে যে অভিজ্ঞতা, তা তাঁর কবিতায় বেশ গভীর ছাপ রেখেছে। অবসর নেন ১৯৯৭ সালে।
১৯৬১ সালে দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়-এর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করে আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেন। পরে প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ। আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হত। একশো আটটি বুলেটিন বেরিয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি’ এবং ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। ১৯৬৫ পর্যন্ত পুরো দমে চললেও, বিখ্যাত হাংরি মকদ্দমার পরে ভেঙে যায় আন্দোলনটি।
১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির জন্য মলয় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ৩৫ মাস ধরে কোর্ট কেস চলে। কলকাতার নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষণা হলেও, ১৯৬৭ সালে উচ্চ আদালতে অভিযোগমুক্ত হন। মলয়ের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত ও সত্রাজিৎ দত্ত। রাজসাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। এই মামলাই মলয়কে বিখ্যাত করে তোলে। ইউরোপ আমেরিকায় তাঁর নাম পৌঁছে যায়। বিখ্যাত ‘টাইম‘ পত্রিকা হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখা প্রকাশ করে। বিভিন্ন ভাষায় মলয়ের কবিতা অনুবাদ করা হয়। সাম্প্রতিককালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘মডার্ন অ্যান্ড পোস্টমডার্ন পোয়েট্রি অব দি মিলেনিয়াম‘ সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত এটিই একমাত্র কবিতা বলে জানিয়েছেন সম্পাদক জেরোম রোদেনবার্গ।
প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ‘ ( কৃত্তিবাস প্রকাশনী, ১৯৬৩ ) থেকেই মলয় রায়চৌধুরী আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতার এক জলবিভাজক ব্যক্তিত্ব । কবিতায় যে-কোনো নিয়মানুবর্তিতা ও আনুগত্যকে মলয় চিরকাল নাকচ করেছেন। তুমুলভাবে ব্যবহার করছেন যৌনতা। আবার সামাজিক চিন্তা ছাড়া তাঁর কবিতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কার-চিত্রকল্পে বিপুল ভাঙচুরের মধ্যেই তাঁর কবিতার সুরে একজন অসহায় ব্যক্তিমানুষের আর্তি ও যাতনা প্রকাশিত। তা ফুটে ওঠে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস, যৌন-অনুষঙ্গে। বাঙালি পাঠক এই সুর সর্বান্তঃকরণে আজও গ্রহণ করতে পারেননি। পারার কথাও হয়তো ছিল না। কবিতা এবং গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি অনুবাদক হিসাবে মলয় সার্থক। ২০০৩ সালে অনুবাদকর্মের জন্য তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার দিতে চাওয়া হলে সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন, কারণ তার আগে বহু লিটল ম্যাগাজিনের পুরস্কার তিনি নেননি।
বর্তমানে মলয় রায়চৌধুরী অসুস্হ। লিখতে গেলে হাত বেশ কাঁপে। কবিতা প্রায় দশ বছর লেখেননি। সময় কাটান ইনটারনেটে। কলকাতাকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে চলে গেছেন মুম্বাই শহরে। সেখানে সস্ত্রীক কাটাবেন জীবনটা।
অনুপম: মলয়দা, কবিতা লেখা এখন তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন আপনি। গদ্য-সাহিত্যে কি মনোনিবেশ করতে চাইছেন পুরোপুরি ? অনেকদিন আপনার কোনো নতুন কবিতা পড়িনি। এই সিদ্ধান্তের কারণ কী ? কবিতা লিখতে ভালো লাগছে না আর ?
মলয় রায়চৌধুরী: ২০০৪-এর পরে আর কবিতা লিখিনি; লিখতে পারিনি। মাথায় যা-কিছু আসে, মনে হয় একঘেয়েমি হয়ে যাবে। আমি তো সেনটেন্সের ভার্সিফায়ার বা স্বভাবকবি নই। ইদানিং কবিতা লেখা ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল আমার আর পাঠকের প্রয়োজন নেই। পাঠকদের চিঠি বা ই-মেল এলে আশ্চর্য অনুভুতিতে আক্রান্ত হই। সমস্যা আমার আঙুলেরও। বুড়ো আঙুলে আরথারাইটিসের কারণে কলম ধরার পর ইরিটেশান হতে থাকে, যা চিন্তাকে ডিসটার্ব করে। ইন্টারনেটে এক আঙুলে কাজ চালাই, কিন্তু কবিতা লিখতে বসে এক আঙুল কমপিউটারে আর সেই সঙ্গে মগজের রসায়নকে সেই আঙুলের ডগায় নিয়ে যাওয়া বেশ অ্যাবসার্ড। নতুন গদ্য লিখিনি; যা কিছু প্রকাশিত হয় সবই পুনর্মুদ্রণ । এক আঙুলে গদ্য লেখা আরও কঠিন। ফিকশানাল গদ্যগুলো জীবনের টুকরোটাকরা মিশিয়ে বানানো। এমন অনেক-কিছু লিখেছি যা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েদের পছন্দ হয়নি, ফিকশানালাইজেশান সত্বেও। প্রবন্ধ লিখতে আর ভালো লাগে না। এক আঙুলে সোশাল নেটওয়ার্কিং এবং ব্লগ যেটুকু যা হয়। আজকাল একটা অদ্ভুত সাইটে ঢুকে পড়েছি; ওটা দেখেছো কি? চ্যাটরুলেট ডট কম । খুললেই স্ট্রেট তোমার সামনে অচেনা কেউ দেখা দেবে, তার ভালো লাগলে দু-মিনিট নিজের ভাষায় কথা বলবে, তারপর অন্য কেউ; মুখোশ পরে ল্যাংটো পোঁদে কেউ-কেউ কোন ভাষায় যে কী বলছে টের পাই না। এটাকে কী বলব? ওয়েবক্যাম থাকলে দেখো। কবিতা কি এই নেক্সটিং পর্যায়ে নিয়ে যাবে? তোমার ও পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা নিয়ে যাবেন আশা করি। কমপিউটারে উত্তর লিখচি বলে ইংরেজি শব্দ চলে আসছে; মুম্বাই শহরটাও তো ইংরেজির দিকে দৌড়োচ্ছে।
অনুপম: মলয় রায়চৌধুরীকে আমরা জানি বাংলা কবিতার নেটিজেন হিসাবেও। আপনার কি মনে হয় ভবিষ্যতে প্রিন্ট মিডিয়া জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ? সেই দিকেই কি এগোচ্ছি আমরা ?
মলয় রায়চৌধুরী: জাহিরুল হাসান ওঁর ত্রৈমাসিক বার্তায় লিখেছিলেন, “মলয় রায়চৌধুরীও নেটিজেন হলেন।” তার মানে আমার আগে কয়েকজন নেটিজেন ছিলেন। ওঁরা কারা তা জানি না। আমাদের ভাষায় প্রথম নেটিজেন কবি, আমার মনে হয়, রোহন কুদ্দুস। বস্তুত আমি তো ভেবেছিলুম রোহন একজন বাংলাদেশি কবি; লজ্জার কথা নিঃসন্দেহে, পরের প্রজন্মের কবিদের লেখাপত্রের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত নই। রোহনকে পথিকৃৎ বলা যায়। আমি যেভাবে লিটেরারি নেটওয়ার্কিং করি, লেখালিখি করি, ইন্টারভিউ ইত্যাদি দিয়ে থাকি, সেভাবে অনেকেই এই এলাকায় প্রবেশ করেননি, তাই চোখে পড়েন না ওঁরা। ভারতবর্ষে বাংলা সাহিত্যে ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার জায়গা মোটেই নিতে পারবে না; অন্তত পঞ্চাশ বছর লাগবে সমান্তরাল মাধ্যম হয়ে উঠতে। বাংলাদেশে কমপিউটার তো বহু বছর ইনট্রোডিউস হয়েছে, কিন্তু এখনও ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার সমান্তরাল নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের লাইব্রেরিগুলোর যা অবস্হা, ছাপা বইয়ের স্হায়িত্ব সমস্যাজনক। স্হায়িত্বের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যম জরুরি হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাইবার কাফেগুলোয় বাংলা ফন্ট নেই, ভাবতে পারো ? এদিকে বাংলা ভাষা বাঁচাও নিয়ে কত চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাই। কমপিউটার ঢুকেছে কুড়ি বছর পর, তার ওপর ইংরেজি শিক্ষা তুলে দেয়া হয়েছিল। নেট স্যাভি একটা কবি-প্রজন্মের উন্মেষ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে, ফলে ইনটারনেটে বাংলা কবিতার জায়গাটা প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু তুমি যদি সুধীন দত্ত, আলোক সরকার, অরুণেষ ঘোষ খোঁজো তো পাবে না। গুগল করলে তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবির অনুবাদ ( আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের দৌলতে) বা তথ্য পাওয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গের জন্যেও তাকিয়ে থাকতে হয় বাংলাদেশি নেটিজেনদের দিকে।
অনুপম: মলয়দা, হাংরি আন্দোলন নিয়ে গত প্রায় পাঁচ দশকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে আপনি হয়তো খুব ক্লান্ত। তবু একটু চর্বিতচর্বণ। এই দু’হাজার দশ সালের মুম্বাই শহরে বসে ষাটের দশকের আন্দোলনটির দিকে তাকালে কীরকম লাগে ? কী করতে চেয়েছিলেন কবিতায় ?
মলয় রায়চৌধুরী: নাহ । হাংরি আন্দোলন নিয়ে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলনের সময় কবিতার অ্যাডিক্ট ছিলুম; কবিতা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাগ। ‘সাহিত্য’ শব্দ দিয়ে ওই ড্রাগ অ্যাডিকশান ব্যাখ্যা করা যায় না। যারা এর অ্যাডিক্ট তারা নিজেরা বুঝে নিতে পারবে; কবিতা ছাপানো, সমালোচনা, আলোচনা এই সবই এই অ্যাডিকশানের প্রেক্ষিতে অবান্তর।
অনুপম: ঠিকই মলয়দা। কিন্তু খারাপ লাগে না, যখন মলয় রায়চৌধুরী এই নামটি পরিচিত হয়ে যায়, কিন্তু যা নন তা-ই দিয়েই সকলে তাঁকে ব্যাখ্যা করতে চায় ? অসহায় লাগে না ? আপনার নামটা জানে, কিন্তু ভুলভাবে জানে, তাই না ? অনেকের কাছে আপনার বয়স ষাটের দশকের পরে আর বাড়েনি। তারা একটা কবিতাতেই আটকে আছে—-’প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’।
মলয় রায়চৌধুরী: আমার তা মনে হয় না। বেশির ভাগ পাঠক, যাঁরা নেট-এ যোগাযোগ করেন, তাঁরা আমাকে গদ্য লেখক বলে মনে করেন, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’-এর লেখক, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ওঁরা আমার উপন্যাসের তালিকা আর প্রাপ্তিস্হান জানতে চান। আমার নিজের কাছে যদিও ‘নখদন্ত’ লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি নন-অ্যাকাডেমিক কলকাতাকেন্দ্রিক কফি-হাউস আলোচকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মিলনসাগর ডট কম-এ ‘জখম‘ সবচেয়ে বেশি হিট পেয়েছে। এই পাঠকরা কলকাতার বাইরের বলে অনুমান করা যায়, যাঁদের কাছে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা সম্পর্কে কিংবদন্তি পৌঁছোয়নি। তোমার যতটা মনে হচ্ছে আমি ততটা পরিচিত নই। কেননা ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসটা আমি একশোজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে, যাঁরা কুড়ি বছরের বেশি পত্রিকা বের করছেন, ডাকযোগে পাঠিয়ে (বইটা তাই দু-টাকার স্ট্যাম্পযোগ্য করে ছাপানো হয়েছিল ), পরে টেলিফোনে ফিডব্যাক নিতে গিয়ে জানতে পারি যে অধিকাংশ সম্পাদক আমার নাম শোনেননি। এমনকি হাংরি আন্দোলনের নাম শোনেননি। অসহায় লাগেনি।
অনুপম: ঠিক আছে মলয়দা। কিন্তু ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি আমেরিকায় জনপ্রিয়। হাংরি মামলা চলার সময়ে ওটার অনুবাদ ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ -এর দৌলতে আপনার কিছু অর্থাগম হয়েছিল, যা আপনার কিছু সুরাহা করেছিল। সেটা আমেরিকা থেকেই পাওয়া । এখনও আমেরিকা-প্রবাসী আর্যনীলের মুখে শুনতে পাই আপনি নাকি ওদেশে জনপ্রিয় বাঙালি কবি। মার্গারেট রেন্ডাল, ক্যারল বার্জ, জেরোম রোদেনবার্গ আপনার লেখা সংকলনবদ্ধ করেছেন, বই ছেপেছেন —- এসব নিয়ে আপনি কী ভাবেন? আমেরিকা কবিতার পীঠস্হান নয়, বাংলা কবিতার তো একেবারেই নয় । তবু — অন্য একটা দেশ —
মলয় রায়চৌধুরী: আগের প্রশ্নটার উত্তরে আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। শুভঙ্কর দাশ দিনকতক আগে ‘আউটসাইডার রাইটার্স ডট অর্গ ‘ -এর জন্যে যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তাতে বাঙালিদের কমেন্টগুলো এসেছে আমার ফিকশান নিয়ে, আর অবাঙালিদের কমেন্টগুলো ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষিতে আমার লেখার সামগ্রিক মূল্যায়ন। ডঃ কবিতা বাচকনভি লিখেছেন যে ভারতবর্ষে ষাটের আন্দোলনের দশকের পর উদয় হয়েছেন ‘বিকাউ’ বা বেচনদার লেখকেরা । আমার কবিতা বিদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বুয়েনস আয়ার্স থেকে স্প্যানিশ ভাষায়, ‘এল কর্নো এমপ্লুমাদো’ পত্রিকায় । প্রথম বই ‘শয়তানের মুখ’ এর প্রচ্ছদ ওঁরাই আঁকিয়ে দিয়েছিলেন মেক্সিকান চিত্রকর কার্লোস কোহিনকে দিয়ে ( স্প্যানিশ ভাষার উইকিপেডিয়ায় হাংরি আন্দোলনের পৃষ্ঠা আছে) । সেই সূত্রে জার্মান সম্পাদক কার্ল ওয়েইসনার ( উইলিয়াম বারোজ-এর সাক্ষাৎকার সংকলক) ওঁর পত্রিকা ‘ক্ল্যাক্টোভিডসেডস্টিন’-এ প্রকাশ করেন। ইউনাইটেড স্টেটস-এর অধ্যাপক হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড ( ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ) সুবিমল বসাক, দেবী রায় আর আমার সঙ্গে কলকাতায় এসে দেখা করার পর আমাদের রচনা আমেরিকায় প্রবেশপথ পেয়ে যায়। ইউনাইটেড স্টেটস-এ বেশি করে নজরে পড়ার কারণ সম্ভবত ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংগ্রহশালার কারণে; আমাদের পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, ফোটোগ্রাফ, ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংরক্ষিত হয়েছে, আবং তা গুগলে স্হান পেয়েছে । ফরাসি ভাষার গুগল সার্চ করলে প্রদীপ চৌধুরীকে বহু পৃষ্ঠায় পাবে। তখন যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁরা অনেকে পরে বেশ প্রতিষ্ঠিত, এবং আমার লেখা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বাণিজ্যিক বাঙালি কবিদের প্রচার আমেরিকায় ভালোই । ডেবোরা কার অ্যালেন গিন্সবার্গকে নিয়ে যে বইটা লিখেছেন তা পড়লে টের পাওয়া যাবে । আমার মামলার জন্য নিউ ইয়র্কের সেন্ট মার্কস চার্চে আমার ও অন্যান্যদের কবিতা পাঠ করে টাকা তোলার আয়োজন করেছিলেন ক্যারল বার্জ,; হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড-ও বই প্রকাশ করে হাই কোর্টের খরচ তুলে দিয়েছিলেন। হাইকোর্টে আমার কেস লড়েছিলেন চারজন অ্যাডভোকেট, তখনকার বিখ্যাত ক্রিমিনাল ল-ইয়ার মৃগেন সেনের নেতৃত্বে। মৃগেন সেনের ফিজ আমার তখনকার মাইনের একশোগুণ ছিল। ‘ছোটলোকের ছোটবেলা’-র ইংরেজি অনুবাদের প্রস্তাব পেয়েছি। দেখা যাক।
অনুপম: মলয়দা, “বিকাউ বা বেচনদার লেখক” ব্যাপারটা একটু বলুন। ধরুন গার্সিয়া মার্কেজ বা সলমান রুশডি, এঁরাও তো বিক্রির ব্যাপারে উদাসীন নন। রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমও কি বিমুখ ছিলেন ? কে চায় না তার বই বিক্রি হোক, লোকে পড়ুক ? পাঠকের কাছে একটু স্পষ্ট করুন ব্যাপারটা।
মলয় রায়চৌধুরী: আমার মনে হয় আয়ারাম-গয়ারাম অভিব্যক্তি দিয়ে বিকাউ প্রক্রিয়াটা বোঝানো যায় । রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমের সময় বাজার ছিল না। ওঁরা বিনামূল্যে বই বিলি করতেন, ডাকযোগে পাঠকদের পাঠাতেন; তার জন্যে ওঁদের সেক্রেটারিরা ছিলেন। মার্কেজ, বর্হেস , রুশডি প্রমুখ লেখকদের আয়ারাম-গয়ারাম বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষেত্রে বিশেষ করে ( বংলাদেশে নয় ), এবং সাধারণভাবে হিন্দি, তামিল, তেলুগু ইত্যাদি ভাষা-সাহিত্যের জায়গাতে বিগ বিজনেস ও রাজনৈতিক-সরকারি খেলার ফলে আয়ারাম-গয়ারাম বাজারের উৎপত্তি হয়েছে। প্রকাশনা ব্যবসাটা আমাদের এখানে ( কলকাতায় ) তিরিশের দশকের পর সেভাবে কাজ করে না যেভাবে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ভাষায়। এখানে প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার কারিকুরির কারণে আউটস্ট্যান্ডিং লেখালিখিটা আয়ারাম-গয়ারামদের ঢাক-ঢোল দিয়ে চাপা পড়ে যায় । আয়ারাম-গয়ারাম লেখকদের রচনা তো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়, কিন্তু কই, এখনও কেউই এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকায় সাড়া ফেলতে পারেননি, যেমনটা ফেলেছেন অরুন্ধতী রায় বা অরুণ কোলাটকার। আয়ারাম-গয়ারাম স্টক এক্সচেঞ্জ না থাকলে মহাশ্বেতা দেবীও বিশ্বব্যাপী ওপেনিং পেতেন ।
অনুপম: এই প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার খেলা কি আপনার সঙ্গেও হয়েছে মনে করেন? আপনার প্রথম বই ‘শয়তানের মুখ’ তো বেরোল ‘কৃত্তিবাস প্রকাশনী’ থেকে ১৯৬৩ সালে। আপনার প্রথম বইয়ের প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । উনি আপনার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বন্ধু । আর সুনীলের সাক্ষই তো আপনাকে হাংরি মামলায় কারাবাস থেকে বাঁচিয়েছিল, তাই না ?
মলয় রায়চৌধুরী: আমার প্রথম বই ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ , তার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিৎ দত্ত ( কবি অজিত দত্তের ছেলে ) লোয়ার কোর্টে আমার পক্ষে সাক্ষ দিয়েছিলেন । লোয়ার কোর্টে (ব্যাংকশাল কোর্ট ) আমার একমাসের জেল অনাদায়ে ম্যাক্সিমাম নির্ধারিত জরিমানার আদেশ হয়েছিল। সাক্ষগুলো আমাকে বাঁচাতে পারেনি। আমার দণ্ডাদেশ খারিজ হয় হাইকোর্টে আপিল করার ফলে, তখনকার নামকরা ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের যুক্তি-তর্কের কারণে । তবে আমি ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে তরুণ সান্যালের প্রতি যিনি কম্যুনিষ্ট পার্টির নিষেধ সত্বেও আমার পক্ষে সাক্ষ দিয়েছিলেন। সুনীল তখন এই সুনীল ছিলেন না; ‘অরণ্যের দিনরাত্রি‘-র সুনীল ছিলেন। ওটা চাইবাসাভিত্তিক কাহিনি, দাদা তখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন। সুনীল সাক্ষ দিয়েছিলেন দাদার অনুরোধে, বন্ধুত্বের খাতিরে, যা উনি লিখেওছেন। তবে ওঁর ‘অর্ধেক জীবন’ পড়লে জানা যায় যে শতাধিকবার দাদার বিভিন্ন চাকুরিস্হলে আতিথ্য নেয়া সত্বেও দাদার সঙ্গে পরিচয়টা উনি লুকোতে পছন্দ করেন। শক্তি চট্টোপাধয়ায় আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ দিয়েছিলেন, তবু উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন; কোনো একটি পত্রিকায় একবার আমার মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হলে উনি সঙ্গে-সঙ্গে আমার খোঁজ নিতে এসেছিলেন। না, আমাকে কোনো রুদ্ধ দরজার সামনে থাক্কা খেতে হয়নি ।আমি চেষ্টা করিনি; ওমুখো হইনি কখনও । সম্ভবত লেখালিখি মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলুম বলেই।
অনুপম: কেন এই ছেড়ে দেওয়া , আর কেন তারপরও আবার ফিরে আসা ?
মলয় রায়চৌধুরী: মনীশ ঘটককে জিগ্যেস করেছিলুম, “কেন লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন ?” উনি বলেছিলেন, “মাথায় আসে কিন্তু হাত অব্দি আসে না।” একই প্রশ্ন সমর সেনকে করেছিলুম। উনি শুধু মোনালিসা হাসি দিয়ে যা বলার বলেছিলেন। আমার ক্ষেত্রে লেখার ব্যাপারটা আমায় দুম করে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, যাকে বলে ‘রাইটার্স ব্লক’ । ফিরে এসেছিল আমার মা মারা যাওয়ার পরদিন থেকে , লখনউতে, যেখানে আমার চেয়ে উনিশ বছরের ছোট এক অবাঙালি তরুণী আমার প্রতি আকৃষ্ট হন। ওই সময় ঢাকায় প্রকাশের আহ্বান পেয়ে যাই একের পর এক লিটল ম্যাগাজিন থেকে। ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর‘-এর অধিকাংশ কবিতা ঢাকায় প্রথম প্রকাশিত। গদ্য লেখার জন্যে জোরাজুরি করতে থেকেন , ইন্সটিগেট করতে থাকেন, ‘কৌরব’ পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তী ।
অনুপম: মলয়দা, বলা কি যায় যে লেখালিখির অক্সিজেন আপনি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেই বেশি পেয়েছেন ? আমেরিকা… বাংলাদেশ… জামশেদপুর… আপনাকে কি বাঙালি কবি সেই অর্থে বলা যায় ?
মলয় রায়চৌধুরী: প্ল্যাটফর্মগুলো বাইরের তো বটেই। তুমি আমার বাল্যের ফিরে-দেখা গদ্যগুলো পড়েছ কিনা জানি না… সেখানে উত্তরপাড়া (আদিনিবাস ), পাণিহাটি ( মামারবাড়ি ), কোন্নোগর (বড়োঠাকুমার বাড়ি ), আহিরিটোলা (পিসিমার বাড়ি, বিখ্যাত সেন্টুদার আস্তানা ), বড়িশা-বেহালা ( সাবর্ণ জেঠু-কাকুর বাড়ি) ইত্যাদি আত্মীয়স্বজনদের গভীর প্রভাব নিয়ে কথাবার্তা আছে । এই রচনাগুলো পাঠকদের কাছে পৌঁছোয় না , কেননা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকরা সীমিত সংখ্যায় ছাপেন। ওইসব রচনাগুলো আমার কবিতার জন্যে পড়ে রাখলে ভালো হয়। আমি তো পূর্ববঙ্গ থেকে এসে বলছি না যে আমি পশ্চিমবঙ্গের। পূর্ববঙ্গ থেকে ধর্ম বাঁচাবার ভয়ে পালিয়ে এসে যদি পশ্চিমবঙ্গের কবি হওয়া যায়, তাহলে উত্তরপাড়ার লোক হয়ে হওয়া যাবে না-ই বা কেন!
অনুপম: আচ্ছা , আপনার আ্ত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ । শুভঙ্কর দাশ যে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেখানে আপনি ঘোষিত হয়েছেন ‘কালচারাল বাস্টার্ড’ বা সাংস্কৃতিক জারজ । অথচ আপনি সন্মানিত পিতার সন্তান। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশধর । আপনার মাতামহ কিশোরীমোহনের নামে পাণিহাটিতে রাস্তা আছে । পাটনার কনভেন্টে পড়াশোনা করেছেন। পরে উচ্চপদে চাকুরি করেছেন। সবদিক থেকেই আপনি সামাজিক, সুরক্ষিত এবং মর্যাদাবান। তাহলে সাহিত্যের আঙিনায় নিজেকে ছোটলোক, জারজ, বহিরাগত, বিহারি বাঙালি — এসব বলার কারণ কী?
মলয় রায়চৌধুরী: সাহিত্যের আঙিনায় নয়; জীবনের আঙিনায় । লেখালিখিটা জীবনের একটা মাত্রা মাত্র । জীবন আরও ব্যাপক, রহস্যময়, ব্যাখ্যাহীন, এলোমেলো, খাপছাড়া, বহুত্বময়, সর্বগ্রাসী। জীবনের সবকিছু লেখা হয়ে ওঠে না, ওঠেনি, উঠবে কিনা জানি না।
অনুপম: তাহলে আরেকটা প্রশ্ন । যিনি স্বভাবকবি নন, হাংরি পর্বে তিনিই কবিতার অ্যাডিক্ট কী করে হলেন, কবিতাকে মাদক জ্ঞান করে বসলেন ? আর এখন নেটিজেন সেই কবি মগজের রসায়নকে কমপিউটারের কি-বোর্ডে নামাতে পারছেন না কেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: তুমি কি অ্যাডিকশান সম্পর্কে জানো? সাইকোট্রপিক ড্রাগস নিয়েছ কি? স্বভাবকবিত্ব ড্রাগ অ্যাডিকশানের বিপরীত জগতের প্রক্রিয়া, যা মূলত মানসিক। অ্যাডিকশানটা শারীরিক, মানসিক এমনকি সামাজিক। আমি জেনে-বুঝে ‘অ্যাডিকশান’ শব্দটা প্রয়োগ করলুম, কেননা ‘নেশা’ শব্দ দিয়ে সাইকোট্রপিক ড্রাগ অ্যাডিকশান ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। আর ‘মাদক’ শব্দটা দিয়ে ড্রাগকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ষাটের দশকে সাইকোট্রপিক ড্রাগ আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ওটা হল আশির দশকের পর। এখন আমার কোনো অ্যাডিকশান নেই; কেবল একা বসে মদ খাবার রুটিন আছে প্রতি সন্ধ্যায়। অনেকের সঙ্গে বসে আমি মদ খেতে পারি না, আমার একাকীত্ব নষ্ট হয়।
অনুপম: মলয়দা, বলুন তো ‘বিস্ময়’ শব্দটা আপনার কাছে কী ? চিরকাল এবং এখন ?
মলয় রায়চৌধুরী: বিস্ময় শব্দের প্রতিশব্দ ‘সারপ্রাইজ’ নয়। ‘সারপ্রাইজ’ বলতে আশ্চর্য হওয়া বুঝব । অনেক-কিছু আশ্চর্য লাগে বা তাতে সারপ্রাইজড হই, কিন্তু তা বিস্ময়ের নয়। আশ্চর্য হওয়াটা তাৎক্ষণিক। বিস্ময় শব্দের ইংরেজি নেই বোধহয়। অন্তত এখনই মনে পড়ছে না। ‘ডিকশানারি অব ফিলজফি’ দেখে বলতে পারব। বিস্ময় ব্যাপারটা লেখালিখির জ্ঞানজটিল, জীবনব্যাপী, একাকীত্বের প্রশ্ন-উন্মীলক। চুপচাপ বসে এই জিনিসটার মধ্যে ডুবে থাকা যায়। প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত জরুরি। জীবনকে সতত প্রশ্নমুখী করে রাখার জন্যে জরুরি।
অনুপম: ‘মলয় রায়চৌধুরী’ কি খুব একা একটা লোকের নাম, মলয়দা ? এই মুহূর্তে ?
মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ।
অনুপম: এই একাকীত্ব কি আপনার অর্জন, না একাকীত্বই বেছে নিয়েছে আপনাকে ?
মলয় রায়চৌধুরী: হয়তো বয়সের জন্যে। ঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। যদি গ্রামাঞ্চলে থাকতুম তাহলে এটা নাও হতে পারত। এই একাকীত্ব কোনো কবিত্বের ব্যাপার নয়; এটা আমি রেলিশ করি। বোদলেয়ারের এনুই-এর সঙ্গে বা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী একাকীত্বের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে।
অনুপম: এখন পিছন ফিরে তাকালে ষাটের দশকের হাংরি মলয়কে চিনতে পারেন ? যে-মলয় সমাজের গণ্যমান্য লোকেদের মুখোশ পাঠিয়ে মুখোশ খুলে ফেলতে বলতেন…. জুতোর বাক্স রিভিউ করার জন্যে পাঠাতেন…. পুলিশের ভয়ে বেনারসে গঙ্গাবক্ষে লুকিয়ে থেকেছেন…. এখন এই আচরণগুলো সমর্থন করেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: পুলিশের ভয়ে গঙ্গায় কেউই লুকোইনি। হিপিদের সঙ্গে গঙ্গার তীরে কেউ-কেউ অবারিত যৌন-জীবন কাটিয়েছেন। ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা‘ পড়েছ কি? বেনারস ছিল সাইকোট্রপিক ড্রাগস এবং হিপিদের জমায়েত । পুলিশ এড়াতে কেবল সুবো আচার্য বিষ্ণুপুরে এবং প্রদীপ চৌধুরী ত্রিপুরায় চলে গিয়েছিলেন, যেখানে ওঁদের বাপের বাড়ি। পুলিশ তবু ত্রিপুরা গিয়ে প্রদীপকে গ্রেপ্তার করেছিল। পেছন ফিরলে কেবল সেই ষাটের মলয় নয়, বহু মলয়কে মেলানো দুষ্কর হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ছাত্রজীবন, যা তুমি তিন কিস্তিতে প্রকাশিত ‘অভিমুখের উপজীব্য’ লেখায় পাবে। পরে লখনউতে আমার অধস্তন তরুণ-তরুণী আধিকারিকদের সঙ্গে ( বোধহয় প্রথম জেন এক্স ) লাগামহীন-বাঁধনছেঁড়া হুল্লোড়ের জীবন; তারপর আটের দশকে সারা ভারত ট্যুর করতে থাকাকালে নতুন ও অপরিচিত জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়ার জীবন। এই সত্তর বছর বয়সে সবই অচেনা ঠেকে, মেলানো কঠিন মনে হয়। যদি রোজনামচা লেখার অভ্যাস থাকত তাহলে তবু মেলাতে পারতুম। রোজনামচা কিছুদিন লিখেছিলুম, কিন্তু জ্বালিয়ে নষ্ট করে ফেলি।
অনুপম: আর যৌনতা ? যৌনতা আপনার কাছে কী ? নাকি কামপ্রবৃত্তি বলব ?
মলয় রায়চৌধুরী: যৌনতা শব্দটার ইংরেজি তো সেক্সুয়ালিটি। তুমি জানতে চাইছ সেক্স আমার জীবনে এবং দৃষ্টিতে কী ? কারেক্ট ? সেক্স আমার জীবনে সবাইয়ের মতন বয়ঃসন্ধিতে ঔৎসুক্য দিয়ে শুরু, কিন্তু নিম্নবর্গের বিহারি সমাজে থাকার কারণে, ইমলিতলা পাড়ায়, তা খুল্লম-খুল্লা বিপর্যস্ত করেছিল। দোলখেলার একদিনের নিষেধহীনতা, ওই সময়ে বয়ঃসন্ধিকালে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ইমলিতলার মেয়েরা, বাঙালিরা যেসমস্ত শব্দকে অশ্লীল মনে করে, সেই শব্দাবলী সহযোগে যাচ্ছেতাই করত। তখন থেকেই সেক্স আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই হিসাবে যে তা অভিমুখ নির্ণয় করে দিয়েছে। পশি-পাখিদের হীট-পিরিয়ড হয়; মানুষের এমন হলে বাকি সময়টা সে তার যৌবন নিয়ে কী করত ? যৌনতা আমার কাছে, আমাদের সংরক্ষণশীল পরিবারে, সীমালঙ্ঘনের, বন্ধন কেটে বেরোবার, হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আমি ক্যাসানোভা ছিলুম না, কিন্তু প্রেম-সম্পর্কের বাইরে, সমান্তরালভাবে, যৌনসম্পর্ক গড়ে ফেলতে আমার ভালোই লেগেছে। তবে একটা ব্যাপার দেখেছি যে, বয়ঃসন্ধিতে সেক্স ছিল মগজ আর শরীরের মিশেল-দেওয়া একমাত্রিক তপ্ততা। যত বয়স বেড়েছে, ততই তা ক্রমশ মগজের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। যৌবনে মুখহীন নারীশরীর ভাবতে পারতুম। যত বয়স বেড়েছে, নারীশরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পৃথক-পৃথক ডাক দিয়েছে। একটা কথা, বিহারে হোমোসেক্সুয়ালিটি ছাত্রদের মধ্যে চালু ছিল । হোমোসেক্সুয়ালিটি, কেন কে জানে, আমার স্ট্রেঞ্জ এবং বিসদৃশ মনে হয়েছে। হল্যান্ডে, অ্যামস্টারডামে, গে আর লেসবিয়ানদের বিরাট জমায়েত হয় প্রতি সন্ধ্যায়। জমায়েতের যুবতীগুলোকে দেখে আকৃষ্ট হতুম, তারা জোড়ায়-জোড়ায় চুমু খাওয়াখায়ি করতে থাকলেও। ওখানের ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্ট অ্যামস্টারডামের বেশ্যা পাড়ায় কনডাক্টেড ট্যুর করায়; সব যৌনকর্মী ছ’ফিটের বেশি লম্বা।
অনুপম: বৌদি এসব জানেন? হাংরি মলয় কি কখনও নিজের চোখে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ এবং আমার কবিতার বিশেষ ধারা, লেখালিখি নিয়ে কোর্টকাছারি, জাল-জরিমানা, হাংরি আন্দোন, এসব জানে; যৌবনের ঘটনা কিছু-কিছু জানে। তবে সাহিত্যকে অনর্থক সময় নষ্ট মনে করে। সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ নেই, যদিও আমার সঙ্গে বিদেশি বা এখানকার কবিলেখকরা দেখা করতে এলে ওর ভালো লাগে, পত্র-পত্রিকায় এবং ইনটারনেটে ফোটো বেরোলে আনন্দিত হয়। আমার মেয়ে অক্সফোর্ড ওপন ইউনিভারসিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ছাত্রী হওয়ার পর যৎসামান্য আগ্রহ হয়েছিল। দাদা ছাড়া আমাদের পরিবারের আর কেউ সাহিত্যে আগ্রহান্বিত নন। ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা চলার সময়ে আমার বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসেমশায় কেউ না কেউ ডেট পড়লে আসতেন। অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের পরিবার থেকে কেউ আসতেন না। তা সাহিত্যের জন্যে নয়। আমাদের বাড়িতে প্রতি প্রজন্মে এক-দুজন পুলিশের মামলায় পড়েছে, তাই এই ঘটনাটা আমার প্রজন্মের প্রাপ্তি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়ে ওঁরা বলেছিলেন, “এধরণের কঠিন-কঠিন পদ্যর কোনো মানে হয় না।” ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাশ’ কবিতাটা ইন্টারনেটে আমার ছেলে পোস্ট করেছিল। আমি তখনও কমপিউটারে টাইপ করতে জানতুম না।
অনুপম: মলয়দা, তাহলে কি খুব দোষ দেওয়া যায়, যখন সাধারণ বাঙালি ভেবে বসেন যে, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি একজন অসুস্হমনা যুবকের যৌনবিকৃতির ফসল ? তা-ও সেই ষাটের দশকে ? যৌনতার নতুন রূপকথা টেরি করতে চেয়েছিলেন কি ?
মলয় রায়চৌধুরী: আমার জ্যাঠা, বাবা, কাকা, মা এমনকি ঠাকুমারও মনে হয়নি যে কবিতাটি নীতিভ্রষ্ট মগজের ফলাফল; ওঁরা কেবল সহজ করে লেখার উপদেশ দিতেন। ‘জখম’ ওই সহজ করে লেখার প্রয়াস। কোনো সাধারণ পাঠক এমন অভিযোগ তো কখনও করেননি, এমনকি অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী এবং শীতল চৌধুরীও করেননি। আনন্দ বাগচী ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি ওঁর সম্পাদিত ‘প্রথম সাড়া জাগানো কবিতা’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন । অভিযোগটা করেছেন অ-সাধারণ পাঠকরা, যাঁরা নিজেরাও কবিযশোপ্রার্থী এবং যাঁরা কলকাত্তাইয়া সাহিত্যের মালিকানা দাবি করতেন। এখন একুশ শতকে পোঁছে ওই অভিযোগকারীরা, যাঁরা বেঁচে আছেন, নিজেরাই টের পাচ্ছেন যে তাঁরা সময় থেকে কত পিছিয়ে ছিলেন। আমি কোনো পাঠককেই দোষ দেব না, কেননা আমি তো জোর-জবরদস্তি পড়তে বাধ্য করছি না। যাঁর যেমন ইচ্ছা তিনি তেমন ভাববেন। কবিতা লিখতে বসে সেক্সকে এইভাবে ব্যবহার করব, ওইভাবে প্রয়োগ করব, এমনটা কখনও ভাবিনি। সেসব ভেবেছি গল্প-উপন্যাস লেখার সময়। কবিতায় সেক্স এসেছে ইমলিতলা পাড়ায় থাকার কারণে । ইমলিতলায় সেক্স জীবনযাপনের একটা স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক উপাদান ছিল। ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বইয়ে পড়ে থাকবে যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে যে কুয়ো ছিল সেখানে পাড়ার বউরা বিয়ের অতিঅশ্লীল গান গাইবার জন্যে দল বেঁধে জড়ো হতেন। সেক্সের নতুন রূপকথা তৈরি হয়ে থাকলে তা ওই দলিত মহিলাদের সাংস্কৃতিক অবদান। ভোজপুরি-মঘাই-পাটনাইয়া বুলিতে বহু সিডি আছে এই সব গানের।