56Th pOst : রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে

লিগ অব নেশনসের কার্যক্রম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপচারিতা
অনুবাদ: মাসুদ খান

লিগ অব নেশনসের কার্যধারা

লিগ অব নেশনসের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে উৎসাহী একদল ছাত্র ও প্রচারকর্মীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল আমার, গত ইউরোপ-সফরের সময়। আরও অনেকের মধ্যে সেখানে ছিলেন অক্সফোর্ডের প্রফেসর জিমার্ন এবং মূলত তাঁরই উপস্থিতি ও উদ্দীপনার সুবাদে লিগের কর্মতৎপরতা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক চিত্তাকর্ষক আলোচনা। আজ মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে লিগ অব নেশনস যখন আবার চলে আসছে দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে, তখন আমার মনে হয় সাম্প্রতিক এই ঘটনাবলির আলোকে পাওয়া যেতে পারে আমাদের সেই আলোচনাটির মজার একটি সারমর্ম। আলাপচারিতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট। - রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ: আজকের ইউরোপ-মানস সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি আমি সম্প্রতি। জার্মানি ও অন্যান্য দেশ সফরের সময় আমাকে একটি বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে, আর তা হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমস্যা নিয়ে আজকাল বেশ ব্যস্তসমস্ত হয়ে চিন্তাভাবনা করছে মানুষজন। এটা এখন আকাশে-বাতাসে, কেউ আর এটাকে উপেক্ষা করতে পারছে না এখন। আমি জানি, সমস্ত রাজনৈতিক হাঙ্গামা সত্ত্বেও মানুষ গভীরভাবে ভাবছে বর্তমান যুগের এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটিকে নিয়ে এবং আশা করছি, জাতিতে জাতিতে মিলন ও স্বার্থের সংঘাত সংক্রান্ত আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে আমি কিছু ধারণা পাব আজ আপনাদের কাছ থেকে।  

এখানে আসার পর থেকে বেশ কয়েকটি উপলক্ষে তরুণদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমার এবং তারা একটি কথা বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছে: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মানস কি মূলগতভাবেই আলাদা? প্রাচ্যের উৎস থেকে উৎসারিত চিন্তাধারা কি আদৌ গ্রহণীয় পাশ্চাত্যের পক্ষে? আমি সত্যিই জানি না, সর্বজনীন মূল্য রয়েছে এমন কোনো চিন্তাকে- যা হয়তো উঠে এসেছে ঘটনাচক্রে প্রাচ্য থেকে- গ্রহণ করা কি পাশ্চাত্য-মানসের পক্ষে সত্যিই কঠিন। আমি নিজে এর উত্তর পেতে চাই এবং এটা জানতে চাই তাদের কাছে, যাদের ধারণা আমাদের মনমানস মূলত এতটাই আলাদা যে, পারস্পরিক দূষণ থেকে নিজেদের রক্ষা করবার লক্ষ্যে আমাদেরকে থাকতে হবে সাবধানে, আলাদা আলাদা সব ঘেরাটোপের ভেতর। আমি বিশ্বাস করি না, করতে পারি না, এবং আমার সায় নেই সেই বৌদ্ধিক ভীরুতায় যা বাধা-সৃষ্টির চেষ্টা করে মানবজাতির সকল অংশ থেকে উঠে আসা চিন্তার সঞ্চালনের ক্ষেত্রে।

যেহেতু আমি আজ এখানে, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে প্রশ্ন জাগছে: লিগ অব নেশনসের চরিত্র ও লক্ষ্য কী? এবং আর কিছু হোক বা না হোক, গড়ে কি উঠতেই হবে এর কোনো রাজনৈতিক চরিত্র? বোধ করি এক শক্তিশালী রাজনৈতিক অভিমুখ রয়েছে এই লিগ অব নেশনসের। কারণ, প্রতিষ্ঠানটিকে চালাচ্ছেন রাজনীতিকেরা, কিন্তু রাজনীতি তো মানবমনীষার একটা অংশমাত্র। কেবল রাজনীতিযন্ত্র নিয়ে নয়, আমাদের কারবার করতে হবে মানবজাতির মনস্তত্ত্ব নিয়েও, এবং এমনকি কূটনৈতিক বাধাবিপত্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়াসে হলেও ধরতে হবে, বুঝতে হবে অখণ্ড মানবমনীষাকে। রাজনীতি তার চরিত্র বদলায় জনগণের মেজাজ অনুযায়ী; রাজনীতির রয়েছে স্থানিক সব প্রতিষ্ঠান, রয়েছে ঐতিহাসিক নানা ঐতিহ্য। আমি জানি না, এই জটিল সমস্যা মোকাবেলার কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস নেওয়া হয়েছে কিনা। জাতিসমূহের প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য লিগ অব নেশনসে কেবল রাজনীতিবিদদেরই থাকা উচিত- বিষয়টিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অসঙ্গত মনে করি। যাঁরা চিন্তাবিদ, যাঁরা স্বপ্নদ্রষ্টা, যাঁরা মানবজাতিতে শান্তি আনবার সেই একই লক্ষে বিশ্বজুড়ে সংগঠিত করে চলেছেন বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান, উচিত নয় কি লিগ অব নেশনসে তাঁদের স্থান থাকাটা? আমি জানি, আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা-সংক্রান্ত একটি কমিটি রয়েছে লিগে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, জাতিতে জাতিতে শুভ বোধের চেতনা জাগিয়ে তোলার সেই কঠিন ব্রত পালনে যতটুকু গভীরে যাওয়া দরকার, ততটুকু গভীরে যায় না ওই কমিটি।

আজকের রাজনৈতিক দুনিয়ায় জায়গা করে নিয়েছে যেসব জাতি, শুধু তাদেরকেই নয়, বরং যাদের নেই কোনো নিজস্ব রাজনৈতিক বলয় কিন্তু রয়েছে আশা-আকাক্সক্ষা, রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন ও নিজস্ব দর্শন, তাদেরকে সহ দুনিয়ার সব জাতিকে একত্রিত করবার বিষয়টিকে কীভাবে সত্যে পরিণত করা যায়, সেটাই হচ্ছে বর্তমান যুগের সমূহ সমস্যা- এটা যাঁরা জানেন, সেই সকল আদর্শবাদীদের একত্রিত করতে পারবে এ-রকম কিছু আন্দোলন লিগের বাইরে জারি থাকা উচিত বলে মনে করি। বিশ্ব রাজনীতিতে যা কিছু ঘটে যাচ্ছে সেগুলোর দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ওইসব জাতিগোষ্ঠী যাদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছে না বিশ্বরাজনীতিতে।

সত্যের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া উচিত বর্তমান যুগের পরিপূর্ণতা। বিজ্ঞান পেরেছে মানবজাতিকে একত্রিত করতে, কিন্তু তা দিতে পারছে না এমন কোনো আদর্শ, যা খোদ বিজ্ঞানকে দিতে পারে তার পরমার্থ। এর জন্য যা দরকার তা হলো, রাজনীতিযন্ত্রের চেয়ে উচ্চতর কোনো কিছুর প্রতি যাঁদের অন্তরে রয়েছে আকর্ষণবোধ, তাঁদের উচিত হবে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে এমন একটি বাতাবরণ সৃষ্টির যথাসাধ্য চেষ্টা করা যা কিনা তার চরিত্রকে দিতে পারে অধিক সম্পূর্ণতা, দিতে পারে মানবীয় স্পর্শ- এতটুকুই শুধু বলতে পারি আমি। তবে আমি আশা করি, যাঁরা এখানে এসেছেন, তাঁরা কী ভাবছেন এই সমস্যাটিকে নিয়ে, সে ব্যাপারে আমাকে কিছু অবহিত করবেন।

জিমার্ন: আমি কিছু কথা বলতে চাই এবং প্রথমেই বলতে চাই, সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে আপনার সঙ্গে আলাপ উপভোগ করতে পারার এ যে কী এক অপূর্ব সুযোগ! যেহেতু আপনি বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতার ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করলেন, তাই ওই বিষয়টি থেকে শুরু করাটা হয়তো আমার ওপরই বর্তায়। আমার মনে হয় না যাঁরা লিগে কাজ করেন তাঁরা এটাকে শুধুই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেন। এটা ঠিক যে, সামনের সপ্তাহেই বিভিন্ন দেশের সরকার থেকে আসতে থাকবেন রাজনীতিবিদরা; কিন্তু লিগের অধিক্ষেত্র তো আরও ব্যাপক, বিস্তৃত; মানবস্বার্থের বিস্তীর্ণ এক এলাকা তো এর অধিক্ষেত্র। আমি এখানে দেখতে পাচ্ছি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আসা বন্ধুদের, দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক শ্রমদপ্তর থেকে আসা বন্ধুদের। লিগের একটি মুখ্য অর্জন হচ্ছে রাজনীতি বিষয়ে আমাদের ধারণাকে প্রসারিত করা, মান্ধাতার আমলের আমলাতন্ত্র যে খুবই সংকীর্ণ তা দেখানো এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক আমাদের ধারণাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া, সংগঠিত জনজীবনের কার্যত প্রতিটি ক্ষেত্র পর্যন্ত। লিগের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মতৎপরতা ছড়ানো রয়েছে বিশ্বের সব
অংশে- এশিয়ায়, আফ্রিকায়। আমার মনে হয়, স্বাস্থ্য বিভাগের নানাবিধ কর্মতৎপরতার ব্যাপারে ড. বি... যদি কিছু বলতেন, তাহলে ব্যাপারটা আপনার আগ্রহকে জাগিয়ে তুলত। লিগ অব নেশনস কোনো পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান নয়, এটা তার চেয়ে আরও দূরের। আপনি প্রশ্ন তুলেছেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য-মানসের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে কি না। জাতিসাম্যের মধ্যে এই যে ভেদ তৈরি করা, এটা দুর্ভাগ্যজনক এবং এটা লিগের পত্তনের সময় থেকেই দিগন্তকে করে রেখেছে মেঘাচ্ছন্ন। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থেকে আসা কর্মকর্তা ও কমিটির সদস্যবর্গ এবং নানা সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতিনিধিকুলের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে কার্যকর রয়েছে দৈনন্দিন পারস্পরিক সহযোগিতা এবং যাঁরা নিয়োজিত রয়েছেন সেই সহযোগিতাকর্মে, আমার মনে হয় না তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন কোনো মৌলিক পার্থক্য। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য- যে বাক্যবন্ধটিকে আমি একটি পুরনোধারা বাক্যবন্ধ জ্ঞান করি- এ দুয়ের মধ্যকার সাধারণ লেনদেন বা সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার চেয়ে বরং মাঝেমধ্যে আমার বেশি কঠিন ঠেকেছে ইউরোপ ও এশিয়ার নতুন ও পুরনো চিন্তাপদ্ধতির প্রতিনিধিত্বকারী মনীষাসমূহের মধ্যকার আদানপ্রদানকে উৎসাহিত করবার কাজটি। এটা আমি দেখেছি আমার ছাত্রদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে। আমার মনে হয়, এখানে টেকনিক্যালি আমরা পেয়েছি রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর একটি সঙ্ঘ, কিন্তু এটা তো জনগণের একটি সঙ্ঘও বটে। কারণ এখানে প্রতিনিয়ত একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন সরকারের সদস্যরা এবং তারা পরস্পরকে জানছে, বুঝছে আরও ভালোভাবে। অবশ্য বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে সেইসব সমস্যা, যা সকল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই অভিন্নভাবে বিদ্যমান; যখন আমরা একত্রে বসি পরস্পরকে আরও ভালোভাবে জানতে-বুঝতে, তখন আমরা সুযোগ পাই সরকার-ব্যবস্থার গভীরতর রহস্যগুলো উন্মোচনের, চিনতে শিখি প্রতিটি জাতির আত্মাকে, তাদের মনোনীত প্রতিনিধিগণের মাধ্যমে। এটাই হচ্ছে লিগ অব নেশনসে কাজ করবার একটি বিশেষ সুবিধা। আর সে-কাজ যদি পারে শিকড় ছড়িয়ে দিতে গভীরে, তাহলে তো কথাই নেই, জাতি ও সংস্কৃতিসমূহের এই যে মেলবন্ধন তা হবে উত্তরোত্তর আরও সমৃদ্ধ, আরও সমুন্নত। জেনেভায় সম্পাদিত কর্মকাণ্ডগুলোর সেটিই একটি মুখ্য দিক।

শ্রম পরিদপ্তরের জনৈক কর্মকর্তা: আন্তর্জাতিক শ্রম পরিদপ্তর হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে লিগের মতো অত রাজনীতিবিদ বা সরকারি কর্মকর্তা নেই এবং তা কাজ করে যাচ্ছে দুনিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মঙ্গলের লক্ষ্যে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু যে কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত তা নয়, এর পরিচালনায় আরও আছেন শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধি (২৫ শতাংশই শ্রমিক-কর্মচারী)। আমাদের এই জুন সম্মেলনে, বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আলাপ-আলোচনায় তর্কবিতর্কে আমরা পেয়েছি কর্মজীবিশ্রেণীর প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ। আমাদের সনদগুলো কার্যকর হয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারের অনুমোদন লাভের পর এবং আমরা কেবল কর্মজীবী পুরুষদের জন্যই নয়, শিশুদের ও কারখানায় কর্মরত নারীদের স্বার্থরক্ষার জন্যও সংস্থান রাখছি সেইসব সনদে। এ মুহূর্তে আমরা একান্তভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি অনেকগুলো সমঝোতাচুক্তির চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবার, যেগুলোর সাহায্যে বিশ্বব্যাপী রোধ করা যাবে শিশুশ্রম শোষণ, এবং চূড়ান্তভাবে ঘটানো হবে তার বিলোপন।

রবীন্দ্রনাথ: এই যে কথাগুলো শুনলাম এর জন্য ধন্যবাদ জানাই আপনাদের, কারণ লিগ অব নেশনসের প্রকৃত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল খুবই অস্পষ্ট। আমি এই ব্যাপারটায় বেশ মজা পেলাম যে, প্রতিষ্ঠানটিতে ছিল রাজনীতির একচ্ছত্র আধিপত্য। সম্ভবত এখনো তা-ই, আর বলা বাহুল্য, প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে  রাজনীতিবিদদের রয়েছে যার যার নিজস্ব স্বার্থ, তাই এটা হয়ে ওঠে একটি দাবা খেলার মতো। প্রত্যেকেই চেষ্টা করে যায় অন্যের ওপর সুযোগ নিতে। কিন্তু লিগ-বিষয়ক কর্মকাণ্ডগুলো বেশ মহৎ। এ মুহূর্তে আমি দেখতে পাচ্ছি সেই মহান চিন্তাবিদ ও লেখক এইচ জি ওয়েলসকে এবং আমি অবাক হচ্ছি লিগ কি কখনো তাঁকে বা তাঁর মতো মানুষদেরকে বলেছে কোনো পরামর্শ দিতে, কিংবা লিগের সমালোচনা করতে; তাঁদেরকে কি কখনো বলেছে লিগের কাজ ও তার বৃহত্তর পটভূমির ওপর নতুন আলোকপাতের সূচনা করতে। সর্বোত্তম চিন্তার সমাবেশ এখানে ঘটাতে হলে তো সুযোগ পাওয়া উচিত সর্বোত্তম মনীষীদেরই এবং তাঁদের চিন্তার সেই সম্মিলনের মাধ্যমেই তো বিকশিত হবে আন্তর্জাতিকতাবাদের এক মহোচ্চ শক্তি।

আমি দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বস্ব^াস্থ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে কাজ করাটা সহজতর, কিন্তু এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো সত্যিই কঠিন। কারণ এখানে যাঁরা আসেন তাঁরা ভাবেন নিজ নিজ দেশের স্বার্থ দেখাটাই তাঁদের কর্তব্য।

জিমার্ন: বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতিনিধিরা মনোনীত হন তাঁদের ব্যক্তিগত গুণাবলির ভিত্তিতে। লিগের বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা-সংক্রান্ত কমিটিতে ঘটেছে এমন সব নারী-পুরুষ ব্যক্তিত্বের সমাহার, যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার, কাজেই জেনেভায় সর্বোত্তম মনীষার সমাবেশের যে কথা আপনি বললেন, তা তো কিছুটা কার্যকর হয়েছেই। কিন্তু এটার একটা সমস্যা আছে। আপনি যখন নির্ধারিত এজেন্ডার ভিত্তিতে গঠন করবেন কোনো কমিটি, তখন আলোচনার আওতা ও পরিসর নিশ্চিতভাবেই হয়ে পড়বে সংকীর্ণ। তবে এখন, আন্তর্জাতিক বিষয়ে উৎসাহীদের নিয়মিত উপায়ে একত্রিত করে গড়ে উঠছে এক সুনির্দিষ্ট আন্দোলন। দুনিয়াজুড়ে শিক্ষক ও অধ্যাপকেরা বৈজ্ঞানিক মনোভাব নিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এইসব সমস্যা। প্যারিসে, লন্ডনে..., যাঁরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে আগ্রহী তাঁরা অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে আলাপ-আলোচনা করছেন এমন অনেক সমস্যা নিয়ে, যেগুলোর ওপর হয়তো এখানে আলোচনা করা সম্ভব হতো না। কেননা তা কূটনীতিকদের মধ্যে উসকিয়ে দিত ব্যাপক বিশৃঙ্খলা।

বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ সম্ভব করে তোলার জন্য প্রয়োজন কল্পনাশক্তির এবং ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকায় রয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান যারা আজকাল ওই ধরনের বিষয়ের ওপর শুরু করে দিয়েছে সমান্তরাল গবেষণাকর্ম। সবকিছু যে তাঁরা এক জায়গায় বসে করবার চেষ্টা করছেন এমন নয়, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একসঙ্গে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে নানা গ্রপ তৈরির চেষ্টা করছেন তাঁরা, সর্বোত্তম চিন্তার সমাবেশ ঘটানোর লক্ষে, ওইসব কঠিন সমস্যা মোকাবেলার জন্য। চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে এক প্রকার কৌশলের কথা এবং এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা-সংক্রান্ত কমিটির কাজের একটি দিকও বটে, যা তার মূল সংগঠন লিগের ওপর নির্ভরশীল নয়।

রবীন্দ্রনাথ: ছাত্রদের মনমানসিকতা আজকাল খুবই চঞ্চল, অস্থির। পশ্চিমের তরুণ প্রজš§র মধ্যে অস্থিরতা প্রথম লক্ষ করেছিলাম সেই ১৯২৬ সালে, যখন আমি ইউরোপ সফর করি। ডার্মস্টাডে তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। যদিও তাদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ, চেহারায় ছিল অভাব ও অপ্রাপ্তির ছাপ, দুর্ভিক্ষের কশাঘাতে কাহিল তাদের অবয়ব, তবুও তাদের চোখমুখে ছিল আদর্শবাদের ঔজ্জ্বল্য। আর তাদের ভেতর ছিল এই বোধটুকু যে, সামনে আছে এক বিশাল ভবিষ্যৎ, আর তা গড়ে তুলতে হবে তাদেরকেই। তরুণদের বেশির ভাগই বলেছে একটি কথা, ‘আমরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের শিক্ষকদের ওপর, তাঁরা আমাদের যা দেন, আমরা চাই তারও চেয়ে বেশি তুষ্টিকর কিছু।বুঝতে পারি, তরুণদের রয়েছে সেই রোমাঞ্চ-অন্বেষী, সাহসী চেতনা যা ভবিষ্যৎ গড়ার তাগিদে সন্ধান করে তার সৃজনশীল মনের মুক্তি। তা ছাড়া আমি দেখেছি ছাত্র-আন্দোলন কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র জার্মানিজুড়ে। অন্য দেশের কথা জানি না, তবে যা দেখেছি সেখানে তাতে এই ধারণা হয়েছে যে, বড় বড় লোকদের সংগঠনের মাধ্যমে পূরণ হবে না এ যুগের ব্রত। আমার কাছে মনে হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই ব্রতের সূচনা হয়েছে তরুণদের হাতে এবং একসময় তা পরিণত হবে প্রজ্ঞায়, এমনকি তাদের ভুলভ্রান্তি আর আকস্মিক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও। এই তরুণদের জীবনযাপন অতি সাধারণ, কিন্তু তারা প্রবেশ করে বিষয়ের মর্মমূলে। প্রথার সেই পুরোনো পথ, যে-পথ তাদের নিপতিত করেছে প্রচণ্ড বিপর্যয়ের ভেতর, সে-পথে না হেঁটে তারা অনুসরণ করছে বাঁচার এক নতুন আদর্শকে। চেতনার এক যথার্থ আন্দোলন আমি লক্ষ করেছি এই তরুণ প্রজš§র মধ্যে।

আমাকে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা রয়েছেন এই লিগে। কারণ, বিজ্ঞানের যেসব সমস্যা সেগুলোতে নেই কোনো জাতিভেদ। আমাদের সম্মিলন বরং হতে পারে সেই জায়গাতে।

একইসঙ্গে এর অসুবিধার দিকগুলোও উপেক্ষা করা উচিত হবে না আমাদের। অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে তাদের। আমার নিজের কাছে মনে হয়, পুরোনো প্রথার ভার এবং বাতিল-অথচ-এখনো-জীবন-আঁকড়ে-থাকা জঞ্জালের নিগড়ে বাঁধা নন এমন আদর্শবাদী ব্যক্তিবর্গ আজ হোক কাল হোক ওইসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করবেনই একদিন। আমার আশা-ভরসা পশ্চিমের এই তেজস্বীমতি, প্রবল উৎসাহে ভরা তরুণকুলের ওপর। যারা ক্ষমতাবান, যারা সফল, সমৃদ্ধিশালী, তারা আদর্শকে দেখেন সন্দেহের চোখে। ড. জিমার্ন যা বললেন আমি তা বিশ্বাস করি। তিনি বলেছেন, কোনো নিয়মবাধিত কট্টর সংগঠনের দরকার নেই আমাদের, বরং দরকার সেইসব ব্যক্তির যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন না বিশেষ কোনো জাতির বা এমনকি বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের। তাঁদেরকে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে একত্রিত হয়ে একটি পরিবেশ তৈরি করবার। জেনেভায় এরকম একটি আন্দোলনের ব্যাপারে আশাবাদী তিনি, বললেন ড. জিমার্ন। তিনি এ-ও বললেন, এখানে শুরু হওয়া কিছু শিক্ষা-কার্যক্রমের ব্যাপারে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। আশা করছি, এই যে শুরুটা, এখান থেকেই বিকশিত হবার সম্ভাবনা বিষয়গুলোর।