স্বদেশ সেন ঃ 57Th pOst

“না উড়ে থেমেছ পাখি, সমস্তটা ওড়ো...”
আবার আমরা এসেছি, রোজকার  বিষণ্ণ সুন্দর সকালের ভেতর জেগে ওঠা এক শ্রাবণ বেলায় ।জামশেদপুর।সীতারামডেরা।পঞ্চাশের লাজুক ,নম্র, উদাসীন আদ্যন্ত এক কবির কাছে।“ পুরোনো বেলার গন্ধ” মাখানো তার নতুন ফ্ল্যাটে।কবি স্বদেশ সেন।সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় সর্বাধিক আলোচ্য ‘নতুন কবিতার’ দিগবিদিকে, জন্ম নাড়ীতে, কোথায় এক পরিবর্তনের প্রধান প্রদর্শক  বলা হয় তাঁর কবিতাকে। যত সময় যাচ্ছে দূরে-সুদূরে প্রায় সারা জীবন একা কাটিয়েও তরুণতম কবিদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন স্বদেশ সেন।বর্তমান বঙ্গদেশে সবচেয়ে জীবন্ত কবি হলেন তিনি।যিনি আজও বিশ্বাস করেন, মানুষের ভেতরে ভেতরে তীব্র ক্ষরণ স্পর্শ করার জন্য শব্দগুলোকে আরো বেশী বেজে উঠতে হবে। শব্দের ভীড় নয়, শব্দের উপযুক্ত প্রয়োগ। শব্দ হবে অপাপবিদ্ধ।নতুন জিভের মত অল্প লাল, একটু শীতের ঘাম জড়ানো, ছড়িয়ে ফোটার মতো আলো হয়ে।
স্বদেশ সেন কখনো চিকৃত , প্রচারমুখী কবি ছিলেন না। তাঁর সারা জীবনে কবিতার বইএর সংখ্যা মাত্র তিনটি।আর একটি সমগ্র।সেভাবে গদ্য লেখেননি নিজের বইএর আলোচনা হলো কি হলোনা সে বিষয়েও তার ঘোর উদাসীনতা
একদা নিখিল বঙ্গের মঞ্চ  থেকে দাপুটে ‘কৌরব’ এর ক্যাম্পগুলোতেও তিনি কম কথার মানুষ ছিলেন।সেভাবে দীর্ঘ কবিতাও লেখেননি।৫০ এর বিশিষ্ট পত্রিকাগুলোতেও ছিলেন অনুপস্থিত।সর্বার্থে তিনি লিটল ম্যাগাজিনের কবি, আর সে ক্ষেত্রেও হাতে গোনা কয়েকটি কাগজে তার বিচরণ।
আমরা পৌঁছে গেছি।স্বদেশদার বাড়ির বারান্দাটি জামশেদপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভিউ পয়েন্ট। একদিকে সুবর্ণরেখা-খরকাই নদী।আমরা দেখলাম দলমার মেঘ ধীরে ধীরে নেমে আসছে শব্দময় দৃশ্যময় ঘরে।স্বদেশদাই তো লিখেছিলেন
কোনো কোনো চোট আমি অনেক সারিয়ে নিতে পারি
সমস্ত মৌরির মত আমিও অনেক সইতে পারি
শুধু উপলক্ষ্য চাই একটু দূরে যদি আমি একা

স্বদেশদার বয়েস ৭৭/৭৮ হলো। কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে যাচ্ছেন।জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি দেশের মানুষ তিনি।কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য।আড়িয়াদহ হয়ে জামশেদপুরে।বিভূতিভূষণের নৈসর্গিক চেতনা যাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে।জামশেদপুরে বসেই যিনি লিখে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের আমগাছের ছায়ার কথা
“হে অনেক আমগাছের দেশ
তোমার একমুহূর্ত ভাল লাগছে
ভাল লেগেছিল তোমার সদা সর্বদা”

পুরোনো মেজাজে বহু অভিজ্ঞতার সহযাত্রী বিশিষ্ট কবি ও কৌরবের প্রাণপুরুষ বারীন ঘোষাল আড্ডা শুরু করলেন। সঙ্গে অতনু ও আমি প্রদীপ চক্রবর্তী
আসুন পাঠক আমরা বিচরণ করি নির্জন এই কবির মনের সেই কৌণিক বিন্দুতে যাঁর সাক্ষী হয়ে থাকবেন শুধু আপনি...নীরবে ...সংগোপনে
বারীনদাঃ হ্যাঁ আজ স্বদেশদার বাড়ীতে আমরা এসে পড়েছি।স্বদেশ সেন আর জীবনানন্দ দাশ দুজনের মধ্যে একটাই কমন, দুজনেই বরিশালের।জীবনানন্দ কিভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন, কাদের ইনফ্লুয়েন্স ছিল, তাঁর মা, তাঁর পরিবারের ইনফ্লুয়েন্স, সে সমস্ত আমরা শুনেছি।স্বদেশদা কিভাবে কবিতা লেখা শুরু করলেন,প্রথম কবে লিখলেন, প্রকৃতির ইনফ্লুয়েন্স না পরিবারের ইনফ্লুয়েন্স- কি ব্যাপার হল- সেই প্রথম দিকের কবিতা লেখা-তাঁর কি মনে হল- কাকে পড়ালেন –কি উৎসাহ পেলেন- একটু যদি স্বদেশদা বলেন...
স্বদেশদাঃ আমি প্রকৃত পক্ষে পরিবারের দিক থেকে সাহায্য বা উৎসাহ যাই বলা হোকনা কেন সেরকম কিছু পাইনি।পরিবারের কেউ ই কবিতা লিখতেননা।চারাগাছ জন্মেছে আরকি,কিভাবে জন্মেছে জানিনা।চারাগাছ যেভাবে বেড়ে ওঠে সেভাবেই একটু একটু করে বেড়েছে আরকি। তো দু একটা কথা মনে আছে, আমরা বাংলাদেশে যেখানে ছিলাম সেখানে আমাদের পাশের বাড়িতে ছিলেন চিত্তরঞ্জন রায় বলে এক ভদ্রলোক।আর তার স্ত্রী ও ছিলেন।উনি হেড মিস্ট্রেস ছিলেন মহিলা বিদ্যালয়ের।তো ওরা খুব কবিতা ,গানবাজনার ভক্ত ছিলেন। ওরা ব্রাহ্ম ছিলেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনারও একটা ব্যাপার ছিল ওদের। ওদের মধ্যে একটা আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহটা সাম হাউ পাশের বাড়ি বলে একটু একটু করে আলো হাওয়াটা আদান প্রদান হয়েছে।চিত্তরঞ্জনদা কবিতা লিখতেন আনন্দমেলায়। আনন্দবাজারের ওই যে ছোটদের পাতা ছিল... আনন্দমেলাই তো?
প্রদীপঃ হ্যাঁ আনন্দমেলা।
স্বদেশদাঃ আনন্দমেলাতে উনি কবিতা লিখতেন ছোটো ছোটো,ঋতু বিষয়ক কবিতা।অধিকাংশই শরতকাল বসন্তকাল,বর্ষাকাল নিয়ে। এগুলো আমার খুব ভালো লাগত। আর আমার পাশের বাড়ির একজন লিখছেন,পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে,পড়ে ভাল লাগছে-এটা ভেতরে ভেতরে জারমিনেট করেছিল। কবিতা লেখার দিকে একটু একটু করে নিয়ে গেছে মনে হয়।এটা একটা ব্যাপার। কথা প্রসঙ্গে এটা বলছি আরকি।তারপর একবার চলন্তিকা সাহিত্য পরিষদের একটা বার্ষিক সম্মেলন ছিল।সেখানে ছোটদের কবিতা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হল।আমাকে জোর করেই চিত্তরঞ্জনদা ওইখানে একটা লেখালেন।কবিতাটা সিলেক্টেড হল, আমাকে ডেকে পাঠানো হল।সেই মঞ্চে গিয়ে পড়লামও।এইগুলি আমার ভিতরে আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল মনে হয়।আমার বাড়ির কাছেই সেই সময় একজনকে পেয়েছিলাম, প্রখ্যাত লেখক বরেন গঙ্গোপাধ্যায়।ছোটগল্পই বেশী লিখেন উনি।ছড়াও লিখতেন।ওঁর ছড়াও আমার খুব ভাল লাগতো। আমি একবার ওঁকে বললাম ,আপনার ছড়ার কালেকশনটা শুনব।বললেন এমনিতো শোনা যাবেনা, একটা পরিবেশ দরকার।আমাদের ওখানে একটা কালভার্ট ছিল।ওখানে ভোর ৫টায় চলে আসবি।গিয়েছিলাম।আমার এখনো মনে আছে ওঁর সেই একটা কবিতা ছিল চারাগাছ বলে।সুকান্তের যে চারাগাছ তার একটা প্রভাব ছিল আজকে বুঝতে পারি।কিন্তু আমার খুব ভাল লেগেছিল।এইভাবে টুকরো টুকরো ভাললাগাগুলো জমে জমে একটা কিছু হয়ে ছিল আরকি ।
প্রদীপঃ আমি একটা জিনিস জানতে চাই স্বদেশদা,বারীনদা বললেন যে বরিশালে আপনার জন্ম, বরিশাল বলতে আমরা জীবনানন্দ দাশকে বুঝি। আরো অনেকেই আছেন কৃতব্যক্তি।জীবনানন্দর কবিতা আপনি কবে পড়তে শুরু করলেন?জীবনানন্দর কবিতায় যেসব জায়গার কথা ,যে নিসর্গের কথা রয়েছে- আপনিওতো সেগুলো দেখেছেন বরিশালে। আমরা আপনার লেখার মধ্যেও অনেক সময় আমরা দেখেছি।সেই পরিবেশ আপনাকে কিভাবে প্রভাবিত করতো –যদি বলেন একটু...
স্বদেশদাঃ দেখ জীবনানন্দ আমি পড়েছি অনেক পরে। তার আগে একটা ভিত্তিভূমি তৈরী হয়েছিল।তখন যুদ্ধের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।১৯৪৫ নাগাদ জামশেদপুরকে খালি করে দেবার কথা বলল টিসকো।জাপানীরা এসে গেছে বর্ডারে।তাছাড়া খাবার দাবারের খুব ক্রাইসিস ছিল। সে সময় বাবা আমাদের পাঠিয়ে দিলেন দেশে বরিশালে সেটাই আমার প্রথম এবং শেষ যাওয়া।আমি বরিশাল দেখেছি সেই সময়েই। তখন আমার বয়েস হবে  ৬-৭ বছর।
বারীনদাঃ আপনার জন্ম কোথায়?
স্বদেশদাঃ ওই পূর্ববাংলায়ই, বরিশালেই আমার জন্ম।
বারীনদাঃ তো বললেন যে যুদ্ধের সময় আপনাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল প্রথম এবং শেষ বরিশালে...
স্বদেশদাঃ প্রথম মানে ওই আরকি ...প্রথম মানে...
বারীনদাঃ জ্ঞান হবার পরে।
স্বদেশদাঃআমি সেই সময়ে বরিশালের যে প্রাকৃতিক রূপটা দেখেছিলাম,সেটা আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে আছে।ভুলতে পারিনি।তারপর যখন জীবনানন্দ পড়ি সেগুলো আর উজ্জ্বল হয়। কিন্তু জীবনানন্দ পড়াটা আমার অনেক পড়ে হয়েছে।আমি কলকাতায় গেলাম ,মানে আড়িয়াদহে।ওখানে একটা লাইব্রেরী ছিল গঙ্গার পাড়ে।আমি যেতাম নিয়মিত।সেখানে ‘পরিচয়’ পত্রিকা সমস্ত বাঁধিয়ে রাখা ছিল।ওখান থেকে কবিতাগুলো পড়তাম।ওখানেই জীবনানন্দকে পেয়েছিলাম,সবাইকেই পেলাম,পরিচয়ে তো সবাই লিখতেন,বিশেষ করে সুধীন দত্ত,সুভাষদা, অমিয় চক্রবর্তী।অ্যাকচুয়ালি আমার প্রথম কবিতাপাঠ ওখানেই।আগে যেটা,ওটা আমার শৈশবের পাঠ।ব্যক্তিগত পাঠ আরকি, আর এইটা কালেক্টিভ পাঠ।
প্রদীপঃ সেসময় আপনার বয়স কত?
স্বদেশদাঃ ধরো ক্লাস নাইনে পড়ি।
প্রদীপঃওই সময় থেকে ওই পরিচয়,ওই পড়াশোনাটা ক্লাস নাইন থেকে?
স্বদেশদাঃ ক্লাস নাইন থেকে মূলত আমার সিরিয়াস পাঠ হচ্ছে।
প্রদীপঃ তিরিশের অন্যান্য কবি অমিয় চক্রবর্তী বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্র নাথ দত্ত এঁদের লেখাও কি সমানভাবে ভাল লাগত? এনজয় করেছেন?
স্বদেশদাঃ আমার এখনো মনে আছে একসময় দৈনিক বাজারটা করার ভার আমার উপর ছিল।যে বাড়িতে থাকতাম রোজ সেখানে সব্জী মাছ এগুলো নিয়ে আসতাম,সেই বাজার করে ফেরার পথে একদিন একটা রূপোর কয়েন পেলাম। কিন্তু কয়েনটা ছিল খারাপ। আমার মনে হল যে...
বারীনদাঃ খারাপ মানে অচল।
স্বদেশদাঃ অচল।আমার মনে হল যে... এটাকে যদি চালানো যেত, তখন আমার টাকা পয়সা বলে কিছুই নেই,অন্যের কাছে থাকি।তার কাছে তো আর টাকা চাইতে পারিনা যে , বই কিনব একটা,বই কেনার আগ্রহ খুব।খোঁজ নিয়ে জানলাম যে কলেজ স্ট্রীটে গেলে ওখানে পুরোনো বইয়ের দোকান আছে, সস্তায় বই পাওয়া যায়।তখনো আড়িয়াদহর বাইরেই কখোনো বেরোইনি।কিন্তু রাস্তাটা আমি চিনে গেলাম।ওই তো গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোড ছিল ওইখানে,ওখান থেকে হাঁটতে থাকো সোজা শ্যামবাজারে পৌঁছে যাবে।শ্যামবাজারে পৌঁছে গেলে পাঁচমাথার মোড়ওইখানে গিয়ে তুমি জিজ্ঞেস করবে কলেজ স্ট্রীট কোথায়? ট্রামে বাসে চাপার অভিজ্ঞতাও ছিলনা,পয়সাও ছিলনা।আমার কাছে সাকুল্যে ওই একটি টাকা,একটি কয়েন আরকি।তখন অবশ্য কয়েনের, মানে যদি ভালো কয়েন হয় সেটার দাম ছিল।আমি হাঁটতে হাঁটতে শ্যামবাজারে গেলাম,ওখান থেকে কলেজ স্ট্রীট গেলামএকটা বইএর দোকানে গিয়ে দেখি, বুদ্ধদেব বসুর ওই বইটা। কি নাম, কবিতা সম্পর্কে ওই যে বইটা, যেটা সমর সেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখা ছিল... কালের পুতুল।ওই বইটা সম্বন্ধে আমার আগ্রহ আগে থেকেই ছিল।যেহেতু ওটা কবিতার সম্পর্কে আলোচনা তাই আগ্রহটা আরো বেশী।বইটা তুললাম,তুলে কত দাম, ওই বারো আনা কি তের আনা এরকম কিছু ছিল।ওই কয়েনটা দিলাম,দিয়ে তো ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছি , কি বলে কি বলে। দেখি ও ওটা অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে।নিয়ে পাঁচ পয়সা ফেরত দিয়ে দিল। আমি বইটা নিয়ে পুরো রাস্তা দৌড়তে দৌড়তে গেলাম। মনে তখন আমার যে কি আনন্দ,কতক্ষণে বাড়িতে গিয়ে ওটা পড়ব। ওই বইটা আমাকে খুব হেল্প করেছে।
বারীনদাঃ ভাবা যায় আড়িয়াদহ থেকে কলেজ স্ট্রীট কত মাইল বলতো...
স্বদেশদাঃ আমি তখনো আড়িয়াদহর বাইরে যাইনি ,পা দেইনি। এই একটা ব্যাপার হয়েছিল।
প্রদীপঃ সেই সময় মানে যখন নয়-দশ বছর বয়স বা তারপরে কালের পুতুল ইত্যাদি পড়ার পর আপনার লেখা শুরু হয়েছিল কখন? কলকাতায় না জামশেদপুরে আসার পর? এখানে মানে লেখা বা ছাপাছাপির ব্যাপারটা, বিভিন্ন জায়গায় লেখা বলতে চাইছি।
স্বদেশদাঃ দেখ ছাপাছাপি মানে কি, আমি ওই আনন্দমেলায় লিখেছি।সে এক ধরণের ছাপা।সেটাকে ছাপাছাপি বলবে কিনা জানিনা কিন্তু সিরিয়াসলি ছাপাছাপি ধরো পরিচয়ে যখন লিখলাম বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা ছোটদের পত্রিকামশালবলে সেই তাতে লিখলাম।সেই সময়টা আমি ওই ক্লাস নাইন-টেন এ।
বারীনদাঃ স্কুল ফাইনাল কবে করেছিলেন বলুননা...

স্বদেশদাঃ তা আমি বলতে পারবনা, মনে নেই।

প্রদীপঃ ৪০ এ ?

স্বদেশদাঃ ৪০ না না আমি কলকাতায়...

বারীনদাঃ ৪৫ এর পরেতো বরিশালে। বরিশাল থেকে ফিরে এলেন জামশেদপুর, জামশেদপুর থেকে তারপর আড়িয়াদহ গেলেন। তখন মিড ফিফটি।

স্বদেশদাঃ হ্যাঁ মিড ফিফটি।আমার কবিতা লেখা আরম্ভ হয়েছে ধরো ওই যখন থেকে আমি পরিচয়ে লেখা আরম্ভ করি তখন থেকে আমার সিরিয়াস লেখালেখি শুরু ধরে নিতে পারো।
বারীনদাঃ তখন আপনি কলেজে পড়েন না স্কুলে ?
স্বদেশদাঃ কলেজে আমি কোনোদিনই পড়িনি। সবসময় স্কুলে পড়েছি।
বারীনদাঃ কফিহাউসে গেছেন কখনো ?
স্বদেশদাঃ কফিহাউসে একবার গিয়েছিলাম।
বারীনদাঃ সেই এক্সপিরিয়েন্সটা মনে আছে ?
স্বদেশদাঃ না খুব একটা মনে নেই। মানে সেখানে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাও ঘটেনি সেরকম কারোর সঙ্গে।
প্রদীপঃ কবে গিয়েছিলেন?
স্বদেশদাঃ ওই ফিফটিজের দিকে। তুষার চট্টোপাধ্যায় আরো কেউ কেউ গিয়েছিল,নামগূলো মনে পড়ছেনা।

বারীনদাঃ  কলকাতায় থাকতে আপনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনেছিলেন ?
স্বদেশদাঃ হ্যাঁ শুনেছিশক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার খুব পরিচিত ছিলেন।
প্রদীপঃ আপনি কি সেই সময় কৃত্তিবাসে বা ওই ‘ইত্যাদি’ পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন?
স্বদেশদাঃ তখন আমি কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার। ফলে আমরা ওদের সব সময় অ্যাভয়েড করতাম।আমার এখনো মনে আছে যে  একবার ওই তুষার চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে –পরে তুষার চট্টোপাধ্যায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিল।তুষার চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে যাচ্ছি।কোথায় যাচ্ছি মনে নেই ঠিক।তো হঠাতুষার বলল এইদিক দিয়ে ঘুরে যাই। বললাম কেন? বলল সুনীল শক্তি ওরা আসছে।মানে তখন ওদের আমরা এরকম ভাবে অ্যাভয়েড করতাম। ওদের সঙ্গে কথা বলাও তখন বারণ ছিল।
প্রদীপঃ মানে এটা কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে তখন নিষেধ ছিল।
স্বদেশদাঃ হ্যাঁ প্রায় একধরণের অলিখিত নিষেধ।
বারীনদাঃ এটা অনুশাসন । অনুশাসন আরকি।
অতনুঃ এই অনুশাসন কি কারণে ছিল এটার ব্যাখ্যা লাগবে।
স্বদেশদাঃ এটা , ওদের ইনফ্লুয়েন্স আমাদের মধ্যে যাতে না আসে।
অতনুঃ মানে ওদের ইনফ্লুয়েন্স আপনাদের চিন্তা ভাবনায় প্রবেশ করতে পারে ?
স্বদেশদাঃ কমিউনিস্ট পার্টির সে দিকটা ...
অতনুঃ আপনাদের কি মনে হত ফারাকটা কোথায়? মানে আপনিওতো সাহিত্য চর্চা করতেন?
বারীনদাঃ যেমন ধর সেই বিচারটা স্বদেশদার না।স্বদেশদা তখন ছাত্র।সেই বিচারটা পার্টির দাদাদের।অনুশাসনটা মেনে চলেছে।
স্বদেশদাঃ ওরা বলতো ওটা প্রকৃতি সৃজন সাহিত্য। আর আমাদেরটাকে বলা হত প্রগতিশীল সাহিত্য।
প্রদীপঃ এখন পড়েন না ওদের কবিতা?
স্বদেশদাঃ এখন আমি পড়ছি,  পড়ছি সবার কবিতাই।সবার কবিতাই আমি পড়ি।
প্রদীপঃ কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে রবীন্দ্রনাথ পড়াও নিষিদ্ধ ছিল।
স্বদেশদাঃ না না আমি পড়তাম।সবারই পড়তাম।
প্রদীপঃ জীবনানন্দ পড়তেন?
স্বদেশদাঃ হ্যাঁ জীবনানন্দ তো বটেই... তাকে বলা হতো প্রকৃতির কবি।
প্রদীপঃ কমিউনিস্ট পার্টির অনুশাসন পর্যায়ের পর আবহমান বাংলা কবিতার ধারায় আপনার চর্চা শুরু হল কিভাবে, মানে কিভাবে পারলেন আড়িয়াদহ থেকে ফিরে এখানে মানে জামশেদপুর এলেন এবং সেই সময় যে পড়া শোনা বা কৌরবের সঙ্গে আপনার যোগাযোগের যে জায়গা সেটা যদি একটু বলেন
স্বদেশদাঃ হ্যাঁ এটা আমার প্রিয় বিষয়। এটা নিয়ে আমি বলতেই পারি। আমিতো প্রগতিশীল কবিতা লিখতাম, পরিচয়ে লিখতাম তারপর বিংশ শতাব্দীতে লিখতাম,এই ধরণের আরো কতগুলি  প্রগতিশীল পত্রিকায় লিখতাম।
প্রদীপঃ প্রগতিশীল ওই কাগজগূলিতে লিখতেন।
স্বদেশদাঃ হ্যাঁ আমি এখন লিখছি।কিন্তু আমি পড়াশোনা করেছি। রবীন্দ্রনাথ  সম্বন্ধে যাই বলুক রবীন্দ্র গুহ ইত্যাদি,রবীন্দ্র গুহ না রবি গুপ্ত। তো সেসব বলার পরেও রবীন্দ্রনাথকে আমি কখনো ছাড়িনি। মানে সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন পড়েছি অমিয় চক্রবর্তীকে ও সেভাবে পড়েছি।
প্রদীপঃ আপনার কবিতার তো একটা চেঞ্জ আপনি বললেন। তো ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ এই বইটার বিভিন্ন কবিতা আমরা যারা অনেক পরে একটু আধটু লেখালেখির চর্চা করতে এসেছি তাদের প্রচন্ড পরিমাণে মানে জামশেদপুরে, কৌরবের সংস্পর্শে আসার পর যখন এই বইগুলো আমরা পড়ছি, আমাদের বিরাট হান্ট করেছে।এবং আপনার ভাষা আপনি বললেন যে, আপনি আবহমানের, আবহমান কবিতার চর্চাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। কিন্তু আসলেও নিজের লেখার যে ভাষা বা শব্দচয়ন বা যে ভঙ্গিমায় আপনি লেখা শুরু করলেন-সেই নিয়ে আপনি আলাদা কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতেন?সেটা কি সরাসরি কৌরবের ছেলেদের সঙ্গে মিশে না আলাদাভাবে একটা প্রস্তুতির জায়গা ছিল আপনার?
বারীনদাঃ আপনি ভাবছিলেন যে আপনার অন্যভাবে লিখতে হবে এবার অথচ আপনি তখনো এবং এখনো আবহমানকালের বাংলা কবিতার যে পরম্পরা সেই পরম্পরাতে শ্রদ্ধাশীল। আপনি সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে কিভাবে বাইরে স্টেপ আউট করেন? আপনার অ্যাটিচুড কিভাবে চেঞ্জ হয়, আপনার শব্দচয়ন কিভাবে চেঞ্জ হয়।আপনি ঘরের মধ্যে-আপনার নতুন অব্জারভেশনে নতুন কবিতা কি ভাবে বেরোয়-এগুলো ধীরে ধীরে কিভাবে আপনার মধ্যে এসেছে ?
একটা হাইটেক আছে। এইযে আপনার সঙ্গে আমাদের পরিচয়, ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ ছাপা হয়েছিল ১৯৮২/৮৩ তে। আর তখন আমাদের কবিতার ক্যাম্প চলছে। এই ১৩-১৪ বছরের মধ্যে দারুণ পরিবর্তন, এই পরিবর্তনটা কিভাবে এসেছে ?
স্বদেশদাঃ দেখো ঠিক সম্পূর্ণ সচেতন ভাবে কিনা জানিনা, তবে এই যে কিভাবে এই পরিবর্তন গুলো এসেছে। আমার মধ্যে শুধু এই একটা খিদে ছিল যে আমাকে আমার মত করে বলতে হবে।আগে যে লেখাগুলো হত তার ভাষাটা সবসময় তার বাকরীতি যেগুলো আমার পছন্দ হত না।আমার মনে হত অন্য একটা কিছু চাই, এরকম ভাবে হবেনা।তার থেকেই ধীরে ধীরে একটু একটু করে আমার কবিতা একটা মোচড় বা বদল নিয়েছে বলে মনে হয়।ভেতরের ওই আর্জটা থেকেই যে ওই ভাষার থেকে একটু বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে।
প্রদীপঃ এই যখন আপনি আপনার মত করে কবিতা লিখছেন, পাশাপাশি আবহমান বাংলায় যে ছন্দ চর্চা চলছে বা জীবনানন্দকে অনুকরণ করে কবিতা লেখার একটা ব্যাপার রয়েছে।এগুলোর পাশাপাশি সাত দশকের যে আন্দোলন গুলো- শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী বাংলা কবিতায় এল-তার একটা প্রভাব পড়ল একদিকের কবির মধ্যে। এসব আপনাকে চর্চার পাশাপাশি কোনভাবে প্রভাবিত করেছে। একদিকে আবহমানের ছন্দের লেখা।পাশাপাশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে কবিতা লেখা হচ্ছে এগুলো নিয়ে আপনি কি কোন খোঁজ খবর রাখতেন? বা কলকাতা কেন্দ্রিক এই আন্দোলনগুলো-আপনি কখনো সে ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন?
স্বদেশদাঃ কলকাতা কেন্দ্রিক যে আন্দোলনগুলো হত সেগুলি সম্পর্কে আমার খুব ভাসা ভাসা ধারণাসব পত্রিকা আসতোওনাকখনো মাঝে মাঝে দু একটা পত্রিকা পেতাম।তাতে ঐ ব্যাপারগুলো জানতে পারতাম।কিন্তু আমার জানাটা কখনো খুব একটা উৎসাহ জাগায়নি আর আমার খুব একটা আগ্রহ জাগেনি। আমার মনে হয়নি যে এটাকে আরো গভীরে গিয়ে দেখা দরকার।সেরকম কখনো ফিল করিনি। মোটামুটি যা হয়েছে তাতেই আমার একটা ধারণা বিল্ড করেছিল। কিন্তু এদের আমি পারসিউ করিনি। আমি প্রধানত ভেবেছি যে একটা বদল, নিজের একটা আইডেনটিটি। আর আমার সব সময় মনে হয়েছে যে কবিতা লেখার একটা পর্যায়ে কবির নিজস্ব মৌলিক ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরী হওয়া দরকারআর যেটা আমাকে হান্ট করতো যে আমার নিজের  ল্যাঙ্গুয়েজ কোনটা? ভিতরে ভিতরে  ছিল ওটা যে আমার নিজের কিছু চাই। তো আমার মনে হয়নি যে আমি সুনীলের মত লিখব, কী শক্তির মত লিখব,কী বিনয়ের মত লিখব। আমার মনে হয়েছে আমার মত লিখতে হবে এবং সেটার কোনো ব্যাকরণ নেই।কোনো বদল যদি হয়ে থাকেতো নিজের থেকে হয়েছে। আমার বোঝাবুঝি থেকে হয়েছে অর্থা আমি যে সমস্ত কবিতাগুলো পড়তাম তার থেকে আমি যা বোঝার চেষ্টা করতাম, পাবার চেষ্টা করতাম তার থেকে কিছু কিছু করে পেয়ে হয়তো কিছু হয়েছে। হলেও হতে পারে।
অতনুঃ এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন সেটা হচ্ছে  যে ভাষার নতুনত্ব বা নিজস্বতা একজন কবির স্বপ্ন। বাংলা কবিতার ভাষা পরিবর্তনের যদি কোনো  পরম্পরা থেকে থাকে এই পরম্পা বাংলা কবিতাকে আজ কোন জায়গায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। আপনার কি মনে হয়,এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আপনার ভাবনা কি ?
স্বদেশদাঃ দ্যাখো পরম্পরাগত যে ধারা সে ধারায় ভাল কবিতা লেখা হচ্ছে কিন্তু আমার অন্তত মনে হয় যে এর কোনো ভবিষ্য নেই। মানে কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে একটা প্রশ্ন প্রত্যেক কবির মধ্যেই থাকে প্রত্যেক সময়ের কবির মধ্যে, কবির একটা দায়িত্ব থাকে যে আমার সময়ের কবিতাকে আমি একটু এগিয়ে নিয়ে যাব সেটা মনে হয় যে পরম্পরাগত কবিতার পক্ষে আজকে বোধহয় সম্ভব নয়।কাজেই আরেকটা দিকে চলেই আসতে হয় নতুন কবিতা যা লিখছেন তাঁদের।কিন্তু সেটাও আমার মত লোক যারা ৩০ এর কবিতা দিয়েপরিপুষ্ট হয়েছি তাদের পক্ষে এটা সম্পূর্ণ মেনে নেয়া খুব ই মুস্কিল যদিনা বারীনের মত ওইরকম ক্ষমতা থাকে।বারীন ওর বয়সেও এটাকে যেভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে,গাইড করতে পেরেছে সবার পক্ষে সম্ভব নয় ,প্র্যাক্টিক্যালি সম্ভব নয়।আমার পক্ষেতো সম্ভবই না।বারীনের একটা জোর হচ্ছে যে ওর পুঁথিগত বিদ্যা এবং ওর বুদ্ধি, মানসিকতা এই সমস্তগুলো। সেই জোরে ও এগিয়ে থাকতে পারে এবং সবাইকে এগিয়ে যেতে উসাহ দিতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে আজকে নতুন কবিতা  যা লেখা হচ্ছে এছাড়া আর কোনো গতিও নেই অন্য কোনপন্থাও নেই। এর মধ্যে দিয়েই কিছু করতে হবে কিন্তু যেটা আমার মনে হয় শব্দ সম্পর্কে বাক্য সম্পর্কে আরো চিন্তার দরকার।বাক্যটাকে আমরা ভুলেই গিয়েছি প্রায়,ভুলে যাচ্ছি।যা পরম্পরাগত কবিতায়- বাক্য যেমন প্রধান, পংক্তি যেমন প্রধান এবং সবটা মিলিয়ে একটা ব্যাপার ছিল।আজকে যদি অনেক কিছু বাদ ও আমরা দিয়ে দিই কিন্তু বাক্যটা একটা ব্যাপার যেটাকে আমরা নেগ্লেক্ট করছি। আমাদের শব্দ এত বেশী প্রধান হয়ে গেছে যে বাক্যটাকে আমরা ভাবছিনা।– আমার মনে হয় যে এটার মধ্যে আরো সামঞ্জস্য দরকার।
প্রদীপঃকবিতায় চমকপ্রদ পংক্তি বা বাক্য এই ব্যাপারটায় আপনি বিশ্বাস করেন? না সামগ্রিক কবিতায় বিশ্বাস করেন ? এটাই আমি জানতে চাইছি।
স্বদেশদাঃ দ্যাখো কবিতায় চমক থাকেই,চমকপ্রদ লাইন থাকেই চমকপ্রদ শব্দবন্ধ থাকেই সেগুলোতো ভালোলাগেই ।ভালোলাগে বলেই চমকপ্রদ।তবে কবিতার সম্পূর্ণতা টোটালিটি।টোটালিটিতে ভালোলাগে।দুটো কিন্তু আলাদা জায়গা, দূটোরই প্রয়োজন আছে।চমকপ্রদও হতে হবে আবার টোটালিটি একটা থাকা দরকার। সে আমার বক্তব্য যদি নাও থাকে তাহলেও একটা টোটাল ইম্প্যাক্ট থাকবে। একটা কবিতা পড়লাম,আমার ভাল লাগল কি ভাল লাগলনা এই একটা বোধের জন্ম হওয়া উচিত।বিক্ষিপ্তভাবে চমকপ্রদও যদি হয়, হতেও পারে কোনো অসুবিধে নেই, এটা ভালই লাগে। কিন্তু টোটালিটি একটা ব্যাপার আছে বলে আমি মনে করি।শব্দ আরেকটু কিছু বলুক,কেবল মাত্র চমকপ্রদ হয়ে না যায়।শব্দগুলো কথা বলুক শব্দগুলোর আরেকটু  কথা বলা উচিত।যেটা তোমাদের প্রক্রিয়ায় কিভাবে তোমরা করবে আমি জানিনা। কিন্তু আমি এটা ফিল করি যে শব্দগুলো কম কথা বলছে।শব্দগুলো নিজেদের চটুলতা নিয়ে ব্যাস্ত বেশী। এই একটা আমার মনে হয়।তবে এখনকার কবি যারা লিখছেন তাদের অসাধারণ শব্দজ্ঞান,অসাধারণ শব্দবন্ধ তৈরী করার ক্ষমতা।
প্রদীপঃ যেটা আমি আমার জায়গা থেকে মনে করলাম একজন কবি একটা কবিতা লিখলেন তার শব্দ তাকেও ছাপিয়ে এমন এক জায়গায় যাবে যেখানে পাঠক এবং কবি দুজনে অভিভূত হয়ে যাবেন কবিতার নেশায়। তারমধ্যে একটা তীব্র আলোড়ন তুলবে, সে মুগ্ধ হয়ে যাবে, সে চুপ করে থাকবে সেই বিমূর্ত নেশায় অথচ তাকে ছাপিয়ে চলে যাচ্ছে শব্দ, শব্দের এই কাজের কথা আপনি বলছেন?
স্বদেশদাঃ যেমন ধরো আমি বলছি ধীমানের কবিতা।ধীমানের কবিতায় মোটামুটি সেই সব জিনিসগুলিই রয়েছে যে গুলো নিয়ে নতুন কবিতা চিন্তা করছে কিন্তু ওর মধ্যে হঠাৎ করে ও একটা কথা বলে হঠাকরে একটা স্পার্ক কবিতার মধ্যে দিয়ে আসে যেটা কবিতা হয়ে ওঠে। এটা পাঠককে গ্রস্ত করে, একটা বিক্ষিপ্ত পাঠককে এই গ্রস্ত করে তোলার ব্যাপারটা আছে ওর। বারীনের কবিতার মধ্যে ওরকম রয়েছে। অনেকেরই কবিতার মধ্যে রয়েছে এটা। এটা ধীমানের মধ্যে আমি বেশী করে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ধীমানের কবিতা কি আইডিয়াল, তাও আমার মনে হয়না।
প্রদীপঃ তার মানে আপনি কবিতার মধ্যে একটা আইডিয়াল জায়গাটাকে খুঁজতে চান।  মানে কোনো একজন, কোন একটা আইডিয়াল থাকবে। আইডিয়াল বলতে আপনি এখানে কি বোঝাতে চাইছেন।যদি আরেকটু বলেন...
স্বদেশদাঃ আমারতো মনে হয় সেই কবিতাই আমি চাই, যে কবিতায় আজ নতুন শব্দ আসবে, নতুন শব্দবন্ধ আসবে, নতুন কম্পোজিশন আসবে-সেই কবিতা, কিন্তু সে আমাকে স্পর্শও করবে। সে আমাকে আমার ৩০ এর কবিতা যে আনন্দ দিত, ৪০ এর কবিতা যে আনন্দ দিত সেই আনন্দ দিতে পারছেনা, পারছেনা কেন?আনন্দ বলতে আমি কিন্তু খুব ব্যাপক অর্থে বলছি।
প্রদীপঃ না আপনি এই সময়ের অভিঘাতের কথাও কি মনে করেন ? ৩০ বা ৪০ এর যে সময় তারপরে তো অনেক কিছু পালটে গেছে- একান্নবর্তী পরিবারে ভাঙন ধরেছে ছোট ছোট পরিবার তৈরী হয়েছে।নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির অন্যরকম সমস্যা হয়েছে। মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে, মনস্ততাত্ত্বিক জটিলতা বেড়েছে, চারদিকের পরিবেশটা বদলে গেছে। তাহলে কি কবিতার ক্ষেত্রে তার প্রভাব থাকবেনা ? বা আপনার কি মনে হয় এখনও কি সেই লেখার মত জায়গাটা আছে?
স্বদেশদাঃ দেখো এই কথা আমি বলছিনা যে ৩০এর মত ৪০ এর মত,৫০ এর মত কবিতা লিখতে হবে। সেটাতো কখনোই সম্ভব না।সময় এগিয়ে যাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতাও এগোচ্ছে।তাদের মানসিক চিন্তা ভাবনা ,তাদের সোসিয়ো ইকনমিক কন্ডিশনগুলো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।তো কবিতা যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে কবিতা ভাবনাও সে ভাবে চেঞ্জ হচ্ছে। সেটা হতেই থাকবে। কিন্তু আমি যখন কবিতা পড়ছি তখন আমি চাই যে রবীন্দ্রনাথ পড়ে আমার যে আনন্দ হত, যে ভাল লাগত, সেই ভাল লাগা ,এটা উপনিবেশিক ভাবনা নয়,রবীন্দ্রনাথের যে শৈল্পিক ভাবনাটা-যে ভাবে স্পর্শ করত-আমি চাই আজকের কবিতাও আমাকে সে ভাবে স্পর্শ করুক। সেই খানে, সেই জায়গাটায় আমি একটু অবাক হয়ে যাই। এটাই আমার মনে হচ্ছে।
বারীনদাঃ মুগ্ধতার কথা, ৩০ ৪০ এর কবিতার অমোঘ ধারার কথা। স্বদেশদার এখন যা বয়স, আমার ধারণা স্বদেশদার ৭৭/৭৮ বছর বয়স। এই বয়সে এখন ৩০ এর কবিতা,৪০ এর কবিতা পড়ে তিনি আর মুগ্ধ হবেন নানিউ জেনারেশনের কথা বলেছিলেন। আজকেও ১৫/১৬ বছরের যে কবিরা আছে, লিখতে এসেছে, তারা যদি এখন স্বদেশ সেনের কবিতা কিংবা আলোক সরকারের কবিতা পড়েন তো তারমধ্যে সেই মুগ্ধতাটা আসবে।কিন্তু এই বয়সে পৌঁছে এখনকার কবিতা পড়ে সেই মুগ্ধতাটা পাবেননা। তিনি কি করবেন টেকনিক্যাল আডজাস্টমেন্টে বিচার করতে পারেন। কবিতা এগিয়ে যাচ্ছে বলতে টেকনিক্যালি কবিতা আরো রিচ হচ্ছে। এটা ভাল লাগছে। কিন্তু সেই মুগ্ধতার বোধটা যা তার হয়েছিল৩০-৪০,৫০ এ, বয়স এগিয়ে গেছে, ফলে সেই মুগ্ধতা বোধটা তো এখন আর হবেনাআমার এরকম মনে হয়।
স্বদেশদাঃ এটা বারীন ঠিক বলেছে। আজকে আর সেভাবে মুগ্ধ হওয়া সম্ভব নয়।তবে আমি বলছিনা যে আজকের যে কবিতা সেই কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ার যে আনন্দ ঠিক সেই জিনিসটা আমি পেতে চাই, ঠিক তা নয়, আমি বলছি একটা টোটাল এফেক্ট যে একটা ভাল শিল্পের কাছে পৌঁছলাম এই ব্যাপারটা হওয়া দরকার।
প্রদীপঃআপনি তো অনেকদিন ধরেই কবিতা লিখছেন , শেষ পর্যন্ত কবিতার কাছে কি চেয়েছেন? একজন কবি কবিতার কাছে তার তো একটা চাওয়া আছে, খ্যাতি,যশ, প্রতিষ্ঠা অনেকে কবিতা লিখে চায় ,অনেকে কবিতা লিখে আনন্দ চায় কবিতার কাছ থেকে শান্তি চায়। আপনি কবিতার কাছে কি চেয়েছেন?
 স্বদেশদাঃ দেখো সত্যি কথা বলতে কি কবিতার থেকে কোনদিনই সেরকম কিছু চাইনি কখনো। খ্যাতি কার না ভাল লাগে?কেউ আমার কবিতা পড়ে ভাল বলুক সেটাতো আমি চেয়েছি, সেটাতো আমার ভেতরে থাকবে, আমি বলি কি না বলি।কেউ যদি ভাল বলেছে আমার ভাল লেগেছে, কেউ যদি খারাপ বলেছে আমার কষ্ট হয়েছে। এগুলোতো আছেই। কিন্তু আমার কখনো মনে হয়নি খুব খ্যাতিবান আমাকে হতে হবে, সেই রকম আমাকে কিছু প্রাইজ পেতে হবে।এইভাবে এই ধরণের ভাবনা আমার ছিলনা।অনেকের ছিলনা ওই সময়। আমি চেয়েছি ভাল কবিতা লিখতে, আমি চেয়েছি কবিতাটা আমার ভাল লাগুক। সবসময় এইটাই আমি ভেবেছি।এবং এই কবিতা যেন সেই থোড়-বড়ি-খাড়া না হয়।আমার নিজের জিনিস হয়- তাহলে আমি খুশি হব। এরকমই একটা মোটামুটি আমার ভাবনা ছিল আমি এটা চাইনি যে আমি অমিয় চক্রবর্তীর মত লিখব, কি সুনীলের মত লিখব, কি শক্তির মত লিখব। এবং লিখে ওইরকম একটা সাড়া পাব চারদিক থেকেআজ যে নতুন কবিতাগুলো লেখা হচ্ছে তাতে আমি একটু মুগ্ধ।কিন্তু আমার ওই একটা কথা মনে হয় যে ঠিক আর্টিকুলেট হচ্ছেনা। আরেকটু আর্টিকুলেট হলে মনে হয় ভাল হতো। তার মানে এই নয় একটা বিষয় নিয়ে আসতে হবে,বিষয় নয়, আমি বলছি ওগুলো আর্টিকুলেট হবে যেটা পাঠকের সাথে কমিউনিকেট করতে পারবে।
অতনুঃ হ্যাঁ, স্বদেশদা,রঞ্জনদা ফোন করেছিল । এই আড্ডায় রঞ্জনদা দুটো প্রশ্ন আপনাকে করেছেন। সেটা হচ্ছে যে কবিতার নতুন কিছু করতে গেলে পুরো ভাঙচুর করে সমস্ত প্রথা, সস্ত কিছুকে ভেঙে তার থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কিছু করার কথা ভাবতে হয়।এটা একটা দিক, আবার পাশাপাশি আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে যে একদম ঘরোয়া পরিবেশ, সমস্ত ঘরের কথা সেখান থেকেও যে নতুনের দিগন্ত খুলে দেয়া যেটা রঞ্জনদার কথা অনুযায়ী আপনি অসম্ভব ভাবে করেছেন।এবং রঞ্জনদা জানতে চাইছিল যে এটা আপনি কিভাবে করেছেন,যদি সেইটা একটু বলেন...
স্বদেশদাঃ দেখো প্রথমত আমি বলি যে, এই যে ভাঙা্র ব্যাপারটা যেটা রঞ্জন বলল সত্যি কি আমরা ভাঙতে পারি সেরকমভাবে,একটা প্রতিষ্ঠিত শিল্প বা দর্শনকে আমরা ভাঙতে যদি পারিও- সেরকম ভাবে কি ভাঙা উচিত? আমার মনে হয় ভাঙাটা গড়ার সঙ্গেসঙ্গে হওয়া উচিত। মানে ভাঙলাম সেই সঙ্গে গড়লাম, বা গড়াটা দিয়েই ভাঙা, রিপ্লেস করলাম, পুরোনো কে রিপ্লেস করলাম নতুন কিছু দিয়ে। এইভাবে একটা নতুন জিনিস গড়ে তুলি।এই রকম একটা ভাবনা আমার আছে।যেমন আমি বলছি কবিতার যে মূল উপাদান, আমার ভয় লাগছেবারীনের সামনে বসে বলতে, কিন্তু আমার এরকম মনে হয়, যেটা মনে হয় খুলেই আমি বলছি যে কবিতায় কি কি থাকবেনা এটা যদি বলতে যাই তাহলে দেখা যাবে কবিতার সব কিছুই যেন আমি ঠেলে সরিয়ে দিলাম। এরকম চিন্তা ভাবনা অনেকে করেছেন এবং খুব নিশ্চিতভাবে করেও তারা ভাল কাজও করেছে।এরকম নয় যে কাজ হচ্ছেনা । কিন্তু আমার মনে হয় সত্যি সেভাবে করা যায়?ভেঙে ফেলব,সমস্ত ভেঙে দেব কালা পাহাড়ের মত, সেইখানে আমি নতুন জিনিস তৈরী করব?
বারীনদাঃ আপনি প্রায়ই বলে থাকেন একটা কথা যে কবিতায় যা বলা হচ্ছে তার বা যে বাক্যগুলো লেখা হচ্ছে তার একটা তাৎপর্য থাকা দরকার।আমাদের জীবনে আমাদের বোধবুদ্ধিতে তার একটা তাৎপর্য যা আপনি বলেছেন সেই ব্যাপারটা যদি বুঝিয়ে বলেন
স্বদেশদাঃ তাৎপর্য  মানে আমি বলছিনা যে সেখানে কোনো দর্শন,বিজ্ঞান কিছু থাকবে তা নয় কিন্তু ওটার একটা ডেস্টিনেশন থাকা দরকার। আমার কবিতার একটা ডেস্টিনেশন থাকা দরকার সেটা কোথায় যাবে।পাঠকের কাছে তা যাবে।পাঠকের স্নেহের কাছে, পাঠকের দুঃখের কাছে, সমবেদনার কাছে কোথাও গিয়ে পৌঁছবে সেটা?আমার এরকম মনে হয়।কিন্তু তাৎপর্য বলতে আলাদা কোনো    তাৎপর্য নেই।তাৎপর্য বলতে আমি যেটা বোঝাই সেটা একটু মিনিংফুল হওয়া। একটু মনিংফুল হবে।
 প্রদীপঃ কবিতার মানে?
স্বদেশদাঃ কবিতার মানে নয়। এইটা গিয়ে পৌঁছলো কোথাও। এই পৌঁছনোটা জরুরী।যেটা আজকের কবিতা মনে করেনা যে পৌঁছনোর কোনো ব্যাপার আছে।মনে হয় তারা আসাধারণ কাজ করছে।কিন্তু পৌঁছনোর জায়গায় গিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, যেটা সামগ্রিকভাবে কবিতার ক্ষেত্রে আমার মনে হয় যে এটা যদি এক জন দুজনের হত তাহলে কোনো ব্যাপার ছিলনা, কিন্তু এটা যখন সামগ্রিক ভাবে হচ্ছে পৌঁছনোর  ব্যাপারটার দিকে কারোর কোনো লক্ষ্য নেই তখন একটা চিন্তা হয় ।মনে হয় যে এই চিন্তাটা থাকলে ভাল হত।তার হাজারটা চিন্তা আছে, তার মধ্যে এটাও একটা চিন্তা। এটা একটা কোথাও গিয়ে পৌঁছনো...
বারীনদাঃ  এখন স্বদেশদা ইদানীং কালে আপনি ইউ বিলং টু টাইম। যখন জীবনে মূল্যবোধের দাম ছিল, যেখানে ঐ পৌঁছে যাওয়া তাৎপর্যের ভ্যালু ছিল এবং আমি নিজেও ফিল করি, নিজেও খানিকটা ঐ ধরণের যে আমার জীবন যাপন যেরকম ... আমি যে কথাগুলো বলব সেই কথাগুলো ডেফিনিট এবং সেই কথাগুলোর দায়িত্ব আমি পালন করব।আজকাল তরুণদের মধ্যে,একদম বাচ্চা ছেলেদের মধ্যে দেখি এই ব্যাপারটা নেই। তাদের কথাবার্তার কোনো দাম নেই,কথাবার্তার যে দাম থাকতে হয় সে ব্যাপারে তারা সচেতন নয়। এরকম হয়ে গেছে সবাই।ইনডেফিনিট কথাবার্তা-পরবর্তী মুহূর্তে আমি কি করব। এখন যা বললাম যে আমি আধঘন্টা পরে ওখানে যাব,আমি আসলে আধ ঘন্টা পরে ওখানে নাও যেতে পারি। আমার সময়ে আমি যদি স্বদেশদাকে বলি দশটার সময়ে আসব,আমি চেষ্টা করব দশটার সময় আসতে। আমি হয়তো সোয়া দশটার সময় এসে পৌঁছতাম। আজকালকার ছেলেরা দশটার সময় আসব বলে একটার সময় আসতে পারে , নাও আসতে পারে। ইনডেফিনিট, এই ব্যাপারটা কিন্তু আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে।ফলে আমরা আবহমানকালের পরম্পরায় শ্রদ্ধাশীল, তার থেকে যে তাৎপর্য  মূল্যবোধ – যে সমস্র সচেতনতার কথা আমরা জেনেছিলাম আমরা শ্রদ্ধা করেছিলাম সেই ব্যাপারটা লুপ্ত হচ্ছে। এই ট্রেন্ডটা থাকা কি খারাপ, না এই ট্রেন্ডটার মধ্যে আবার নতুন উত্থান সম্ভব, আপনার কি মনে হয়?
স্বদেশদাঃ দেখো যেটা খারাপ সেটা তো খারাপই, এখন যদি কথা দিয়ে কথা না রাখে সেটা তো সবসময় খারাপ।এটা যদি অ্যাকিউমুলেট করো তাহলে সেটা সমাজের পক্ষে খারাপ।তো সেটাতো কেউ অস্বীকার করবেনা।কিন্তু যে মূল্যবোধের কথা তুমি বললে বা তার পরিবর্তন হওয়ার কথা বললে সেটা কিন্তু সেই মূল্যবোধ বলতে রবীন্দ্রনাথ যা মনে করেছেন আর জীবনানন্দ যা মনে করেছেন সেই মূল্যবোধ কিন্তু আজকে সম্ভব নয়।আজকের দিনে আজকের মতই সমাজকে স্বীকৃতি দিতে হবে। সুতরাং ওগুলো কোনো ব্যাপার নয়।আগেকার দিনে রবীন্দ্রনাথ কি ভাবতেন জীবনানন্দ কি ভাবতেন ওটা কোনো ব্যাপার অয়।আজকের ভাবনা আজকেরই এবং আজকের দিনের ছেলেরাই ভাববে।আর তারপরে সবচেয়ে বড়কথা যে আমার ৭৬-৭৭ বছর বয়স হয়ে গেল। আমার পক্ষে আর কত দিন এই নতুন কবিতাকে কতখানি নেয়া সম্ভব।ভাবনার ক্ষমতাও তো একটা থাকতে পারে।আর প্রত্যেক যুগেই তো এটা হয়েছে যে নতুন কবি যারা আসছে পুরোনো কবিরা তাদের বলছেন যে হচ্ছেনা, এটা করতে পারছোনা, এই জিনিস হচ্ছেনা, আমাদের সময় এইরকম ছিলনা –এটাতো আমি জানি।এই ইতিহাসটা একটা পুরোনো ইতিহাস।সুতরাং সেখানেও আমার প্রচুর সন্দেহ আছে, যে আমি যেগুলো বলছি সেগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক। এটা কি আমার না মেনে নেয়ার জন্য এসব কথা বলে যাচ্ছি? হতেই পারে। প্রত্যেক যুগেই এরকম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করতে পারেন নি, জীবনানন্দ বা বিষ্ণু দে ও।সেখানে কিছু দোষের নেই। আমি যদি সেরকম কিছু বলে থাকি,খুব স্বাভাবিক আমার পক্ষে বলা।কিন্তু এইটা বুঝতে হবে যে যদি কেউ আমার কথা শোনে এর মধ্যে কোথাও কি একটুখানিও সত্যি আছে,কোথাওকি ভাববার কিছু আছে? সেটা যদি হয়, সেটা মঙ্গল।কিন্তু এটা কোনো আমার দাবী নয় যে আমি যেটা বলছি ঠিক বলছি।আমি সব জেনে শুনে বলছি যে প্রত্যেক যুগ তার পরবর্তীযুগকে সন্দেহ করে। সন্দেহের চোখে দেখে এবং তাদের এলেম কম মনে করে।এই সব কথাগুলো,এর মধ্যে ভুল্ভ্রান্তি থাকতেই পারে। সেগুলো বুঝে নিতে হবে আজকের কবিদের, নতুন কবিদের। তবে একটা কথা আমি বলব যে কবিতাকে আরেকটু এগিয়ে যেতে হবে।
প্রদীপঃ না স্বদেশদা, যেটা বললেন সেটা ঠিকই কিন্তু এইযে এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে কবিতা গুলো লেখা হচ্ছে আজ থেকে ৪০-৫০ বছর পরে এই সময়ের সাথেই অভ্যস্থ হয়ে পড়বে সেই প্রজন্মের তরুণরা, হয়তো এই ধরণের লেখাই তাদের ভালো লাগবে বা ভালো লাগবেনা, তখন কি এই ধরণের মানে অতিক্রান্ত কোনো চমকপ্রদ দিক বা সব কিছুকে অতিক্রম করে যাওয়ার কোনো সুখ তখনো কি থাকবে মনে হয় আপনার?আপনার কি মনে হয়না এটা চিরকালীন?চিরকালীন বলে কোনো কিছু আছে বলে আপনার মনে হয় কি?
স্বদেশদাঃ দেখো চিরকালীন যেটা সেটা হচ্ছে মানুষের আনন্দ দুঃখ বেদনা- এগুলোই চিরিকালীন। এছাড়া আর কিছু নয়।তো এগুলো থাকবেই এবং এগুলো যে তোমার কলমের রেঞ্জের মধ্যে রাখতে হবে।এগুলোর বাইরে কিছু নয়।তোমার কবিতায় যেন আনন্দের কথা থাকে, দুঃখের কথা থাকে , যেন হতাশার কথা থাকে, যেন জয়ের কথা থাকে,সমস্তই  যেন থাকে এবং সেটা যেন কোথাও গিয়ে পৌঁছায়, একটা ডেস্টিনেশনে।তো এটা যেন থাকে।এটাই আমার মনে হয় যে  এখনকার কবিতায় যা আছে সেটা কম আছে।আজকের কবিতার খামতি বলতে পারো যে কোথাও একটু কম পৌঁছচ্ছে। খালি কবিদের কাছে পৌঁছলেতো হবেনা, সাধারণ মানুষের-দেখো একটা কথা বলি যে কিছু কিছু লোকতো আছে যাদের রবীন্দ্রনাথের গান,রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা জীবনানন্দের কিছু কিছু কবিতার কিছু কিছু লাইন-দেখো আজকে আমরা একটা লাইন খুঁজে পাইনা যেমন জীবনের আনন্দের মুহূর্তে, দুঃখের মুহূর্তে ,হতাশার মুহূর্তে-সেই ধরণের একটা লাইন আজকের কবিতায়। কেন এইটা হবে, কেন এগুলোই যদি খুঁজে না পাই তাহলে কবিতা কিসের জন্য, কিসের জন্য লেখা হচ্ছে কবিতা?কবিতা তো শব্দসম্ভার নয়, কবিতার তো কিছু বেসিক থাকবে,বেসিক সেই অর্থে বক্তব্য নয়।একটা অনুভূতি জাস্ট। ধরো আজকের কবিতা নানান রূপে অন্য ডাইমেনশন পাবে। বোঝা যাবে তার প্রস্তুতি পর্ব।নট নেসেসারিলি যে সেটাই হতে হবে, তা না।তো অন্য কোনোভাবে অন্য কোনো ডাইমেনশন হতেই পারে।মনে হয় যে এটা যদি আরেকটু আমি স্পষ্ট করতে পারতাম,এটা যদি আরেকটু আমার চামড়ায় গিয়ে লাগতো- এই স্পষ্টতা আমার যেন ভাল লাগত। আমার গায়ে এসে লাগছেনা কোনো কবিতা আমার গায়ে এসে লাগছেনা ।এই বয়েসে এসে আমার এটা মনে হয়েছে।অন্য রকম তো হতেই পারে । এইসব নানারকম ভাবনা আরকি।
অতনুঃ এই প্রসঙ্গে স্বদেশদা আপনি যেটা বললেন সেই প্রসঙ্গে বলি আগেরবার যখন আপনার বাড়িতে আমরা এসেছিলাম তখন আপনি বলে ছিলেন যে তোমরা যেরকম আমার কবিতায় ঋদ্ধ হয়েছো ঠিক একই রকম ভাবে আমিও তোমাদের কবিতায় ঋদ্ধ হয়েছি।আপনি আজকে যেটা বলছেন, যা বলেছিলেন-ওই দুটোকে মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে যেন কোথাও একটু সমস্যা হচ্ছে। একটু সমস্যা হচ্ছে স্বদেশদা...
স্বদেশদাঃ না দেখো এই সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই ,আমি আজকে যদি কবিতা লিখি, যখন কবিতা লেখার ইচ্ছে হয়, তখন আমি কিন্তু ঐ জীবনানন্দ পড়িনা,আমি তোমাদের লেখা পড়ি। আর ঐ লেখাগুলো না পড়লে লিখতেও পারিনা।সত্যি বলছি।তো ঐ লেখাগুলো থেকেই আমি লিখি।সেদিন যে কথাটা বলেছিলাম, আমার মনে হয় এই কথাটাই বলেছিলাম যে তোমাদের লেখা থেকে আমি ইন্সপিরেশন পাই।বারীনের কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।সেখান থেকে আমি আমার কবিতার লাইন পাই।আমি আমার নিজের মত করে সেই লাইনটা তৈরী করি।আমার পক্ষে বারীনের মত লেখা সম্ভবও নয়। কিন্তু আজকে আমি এটা স্বীকার করি যে,যেসব নতুন কবিতা লেখা হচ্ছে, নতুন কবিতা যারা লিখতে এসেছে,তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের মধ্যে যে ক্ষমতা রয়েছে এটা বিস্ময়কর।আমার এটাই মনে হয়। এই ক্ষমতা দিয়ে কবিতাকে একটা অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিতএটা আমি ভীষণ ভাবে আশা করি।
অতনুঃ আমরা একটা কাগজ করি, যে ডিটারমিনেশনের কথা হচ্ছিল, সেই প্রসঙ্গে আপনার কি মনে হয়,পত্রিকাগুলো ঠিকঠাক তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেনা? আপনি তো  প্রায় সব কাগজই দেখছেন বা পড়ছেন, যদি নাহয় তাহলে কিভাবে কিরকম ভাবে ভাবা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
স্বদেশদাঃ দেখো এখনকার কাগজ, যে পত্রিকা গুলো বেরোচ্ছে,যেমন ধরো নতুন কবিতা,ভিন্নমুখ,বা এখন বেরোচ্ছে, এগুলোয় খুব ভাল ভাল কবিতা ছাপা হচ্ছে এবং আজকের কবিতা বেরোচ্ছে।আমার মনে হয়না সম্পাদনায় কোথাও ঘাটতি আছে।তবে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে নিজেদের ভেতরে আলোচনা-এই আলোচনার মাধ্যমে অনেকটা ঠিক করা। আর...
প্রদীপঃ এই প্রসঙ্গে একটা জিনিস জানতে চাই যে আপনি কি মনে করেন যে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে সঙ্গের দরকার হয়, পরস্পরের মধ্যে আলোচনা দরকার হয়।মানে আমি যতদূর জেনেছি আপনি একসময় কৌরবের ডাকে গেছেন পরবর্তী ক্ষেত্রে মানে কৌরবের ডাকে আর যাননি। একা একা নিজে লিখেছেন, লেখার চেষ্টা করেছেন। আপনি কি মনে করেন কবিতাকে কন্টিনিউ করতে গেলে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপে বা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার, নিরন্তর মানসিক আদান প্রদান দরকার,না আপনি বিশ্বাস করেন একা থাকলেও নতুন নতুন কিছু লেখা যায় বা নিজের কবিতা পরিবর্তন করা যায়।কোনটা বিশ্বাস করেন?
স্বদেশদাঃ দেখো আমি এটা বিশ্বাস করিনি যে যে কোনো শিল্প চর্চাতেই অ্যাসোসিয়েশনের দরকার। তবে মানুষের কাছাকাছি থাকা দরকার। কিন্তু একা একাও যে লেখা যায়না তা নয়, একা একাও কখনো লেখা যায়। অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, যারা শিল্পকর্মে একাই নিয়োজিত ছিলেন।অনেকের তো কোনো বন্ধুই ছিলনা। সুতরাং ওটা কোনো ডেফিনিট ব্যাপার নয় ।তবে আমার নিজের মনে হয় সব সময় মত বিনিময়টা দরকার যার থেকে অনেক কিছু ইনপুট পাওয়া যায় আমার তো এরকমই মনে হয়। তবে কিছু লোক মানসিক ভাবে এমন ভাবে তৈরী থাকে যাদের এটা নাহলেও চলে যায়।
প্রদীপঃ আচ্ছা আপনার মোটামুটি তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে ‘রাখা আছে কমলালেবু’ ‘মাটিতে দুধের কাপ’,’ছায়া আসিও’পরে ‘স্বদেশ সেনের স্বদেশ’ । অনেকদিন ধরে লেখালেখি করেছেন কবিতার বইএর সংখ্যা এত কম কেন?মানে সেটাকি কম লেখালেখি করার জন্য কিংবা নিজের থেকে কোনো ইচ্ছে জাগেনি বলে?আরো কিছু করব এরকম কিছু ব্যাপার আছে?
স্বদেশদাঃ দেখো আমার কবিতার বই বের করার ব্যাপারে খুব যে একটা ভেতর থেকে আগ্রহ সেরকম ছিলনা। সেরকম আমার মানসিক দিক থেকে কোনো তাগিদ নেই যে একটা কবিতার বই বের করতে হবে, অনেকগুলো কবিতাতো হল, একটা বই বের করি। এই চিন্তা আমাকে হান্ট করেনি কখনো। বরং দেরী হলেই ভাল হয়।আমার প্রথম কবিতার বই যখন বেরিয়েছে তখন আমার ৪২ বছর বয়েস। তো স্বাভাবিক ভাবেই আমার বইএর সংখ্যা ও কম হয়েছে।
বারীনদাঃ অনেকেই আছেন সংখ্যা নয়- কেন লিখছি, কি লিখছি- সেটাই প্রধান।তিনটি বই লিখেই স্বদেশ সেন এমন জায়গায় চলে গেছেন যে ওনার ফ্যান ক্লাব তৈরী হয়ে গেছে।আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম আজ থেকে প্রায় ১৩/১৪ বছর আগে স্বদেশ সেন ফ্যান ক্লাব কলকাতায়! বারীন ঘোষাল ফ্যান ক্লাব তো নেই কোথাও। এটা রবীন্দ্রনাথ বা কবিগুরু ফ্যান ক্লাব হলে মানিয়ে যায়। মাত্র তিন খানা বই নিয়ে স্বদেশ সেন ফ্যান ক্লাব !!!! কোন প্রচার মাধ্যমে যাননি,কোনদিন কোন প্রচারের জন্য দৌড়ননি, কফিহাউসে যাননি। রবীন্দ্রসদনে যাননি মঞ্চে যাননি । কোথাও যাননি। কেউ ডাকেওনি , যানওনি পাত্তাও দেননি। লিখেই তো আজকে এই জায়গায় এসেছেন যে আমি বলি আমার গুরু। কেন বলি, তার জন্য গাদা গাদা লিখতে হয়না।
প্রদীপঃ ঠিক ই স্বদেশদা বারীনদা বললেন এই প্রসঙ্গে আপনার ফ্যান ক্লাব তৈরী হয়েছে,মানুষের যে ভালবাসা আপনি, আপনার সবচেয়ে বিস্ময় লাগে যে কোন রকম প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে না থেকে সেই অর্থে বহু পত্র পত্রিকায় না লিখেও  আপনি পাঠকদের কাছে ছড়িয়ে গেছেন এবং নতুন দের কাছে নতুন যারা কবিতা লিখতে আসছে তাদের কাছে ছড়িয়ে গেছেন এটাতো আমাদের কাছে বিস্ময় বলেই মনে হয়। এবং এই ব্যাপারটায় তো আপনার একটা ভালোলাগা তৈরী হয়, ভালোলাগার একটা জায়গাও আপনার তৈরী হয়।আপনার আসন্ন যে সময় এই সময়ে আপনার কি নতুন কিছু লেখার ইচ্ছে আছে বা নতুন কিছু করার কি ইচ্ছা আছে কবিতা নিয়ে,নতুন কিছু ভাবছেন কি কবিতা লেখা নিয়ে বা কবিতা লেখার ব্যাপারে নতুন কিছু কি ভাবনাচিন্তা আপনার মধ্যে কাজ করছে এখন?
স্বদেশদাঃ...... খালি মনে হচ্ছে যে আলোয় আলোয় বিদায় নেয়া, ভালোয় ভালোয় চলে যাইআর নতুন করে কি ইচ্ছা হবে বল! ভেতরে এখন সমস্ত এনার্জি গুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। নতুন ইচ্ছা আর কি আসবে। লিখতে যে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেনা তা নয়,ইচ্ছে করে কিন্তু ঠিক সামর্থ যেন পাইনা, যেমন এখন রাস্তায় ঠিকমত হাঁটতেও সাহস পাইনা।,ভয় হয়, হত আমি হেঁটে যেতে পারব, কিন্তু ভয় হয় কিজানি মাথা ঘুরে গিয়ে পড়ে যাব নাকি, মানে দুর্বলতা একটা। সেরকম কবিতা লিখতে গিয়ে মনে হয় যে লিখব , কি ছাইপাঁশ লিখব, আর কি হবে লিখে। লিখলাম তো এতদিন আর কি হবে লিখে।আরো দুটো কথাবলে আর কি নতুন কথা বলব। এরকমই মনে হয়। এখন আমি দেখি কে কি লিখছে, কিরকম লেখা হচ্ছে।
অতনুঃ কি ভাবে এই অসাধারণ কথা মনে হয়ে ছিল-‘নতুনের কোনো দুঃখ নেই’ ?
স্বদেশদাঃ আমার ভালো করে মনেও নেই যে কি ভেবে লিখেছিলাম, তবে এইটা মনে আছে, যে নতুন তার সামনেতো সারা পৃথিবী, তার সামনেতো সমস্ত পৃথিবীটা পড়ে আছে।তার দুঃখ থাকবে কেন, দুঃখ থাকার নয়, নতুন যে তাকে তো কত কাজ করতে হবে, তার সামনে কত দায়িত্ব। নতুনের দুঃখ কেন থাকবে।সে যেখানেই থাকুক দুঃখ থাকার তো কথা নয়। দুঃখ যেন তাকে না ছুঁতে পারে।
অতনুঃ এবার আমরা স্বদেশদাকে অনুরোধ করব আপনার ভালোলাগা কিছু কবিতা আমাদের পাঠ করে শোনান।
(স্বদেশদা আমাদের অনুরোধে বেশ কয়েকটা কবিতা পড়লেন যা আমাদের রেকর্ডারে বন্দী হয়ে থাকল সারাজীবনের সম্পদ হয়ে।স্বদেশ সেনের নিজ গলায় কবিতা পাঠ, সেও বিরল মুহূর্তগুলির অন্যতম হৃদয়ের মাঝে , বুকের গভীরে...)
বারীনদাঃ কবি স্বদেশ সেনের সঙ্গে এতক্ষণ কথা হল এটা আমাদের সৌভাগ্য। স্বদেশদা এতক্ষণ ধরে আমাদের সহ্য করলেন বলা যায়। স্বদেশদাকে ধন্যবাদ জানাই। আর ধন্যবাদ জানাই অতনুকে,প্রদীপকে জামশেদপুরে ছুটে এসে স্বদেশদার কাছে বসে এটা গ্রহণ করার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরী মাচ অতনু আর প্রদীপ।
অতনুঃ স্বদেশদা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সকলের পক্ষ থেকে এবং ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’এর পক্ষ থেকে।
স্বদেশদাঃ অতনুকে ধন্যবাদ জানাই যে এত কষ্ট করে তোমরা এসেছো, আমার মত একজন সামান্য কবিকে এই সম্মান দিলে-এতে সত্যি আমি আশ্চর্য হয়ে যাই... মাঝেমাঝে খুব আশ্চর্য হয়ে যাই তোমাদের এই স্পর্শে।খুবই অবাক লাগে সত্যি!
                                       =০=

সৌজন্য ঃ এখন বাংলা কবিতার কাগজ এবং কবি ও গল্পকার তপতী বাগচী